আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি-র ওভাল অফিসে ভেস্তে যাওয়া নাটকীয় বৈঠক আন্তর্জাতিক কূটনীতির চর্চায়। দু’পক্ষের অভূতপূর্ব বাগ্বিতণ্ডা এবং কটুকাটব্যের পরে ভূকৌশলগত পরিস্থিতি কোন দিকে এগোয়, সে দিকে সতর্ক নজর রাখছে ভারত। অন্য দিকে, ইউরোপ একজোট হয়ে আজ জ়েলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে নতুন ভাবে তৈরি হওয়া আন্তর্জাতিক ব্লক রাজনীতি।
এখনও পর্যন্ত ট্রাম্পের গত কালের আচরণ নিয়ে কোনও সরকারি প্রতিক্রিয়া জানায়নি ভারত। অর্থাৎ গত কয়েক বছর ধরে এই ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যের নীতি মোদী সরকার নিয়েছে, সেই সরু দড়ির উপর দিয়েই যে ট্রাম্পের নতুন জমানায় হাঁটতে হবে, তা বিলক্ষণ বুঝছে সাউথ ব্লক।
এটা ঘটনা যে, আমেরিকা ভারতের কৌশলগত অংশীদার। বিশ্বের বৃহৎ এই শক্তির সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে নিজেদের স্বার্থ যে উদ্ধার করা যাবে না, তামোদী সরকার বোঝে। কূটনৈতিক শিবির মনে করছে, আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পশ্চিম এশিয়া এবং জাপানের মতো কিছু দেশের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা যে ভারতের মধ্যে প্রবল ভাবে দেখা যাচ্ছে, তা ট্রাম্পের প্রতিস্পর্ধী একটি অক্ষ তৈরির জন্যই। তা ইউক্রেনকেও অখুশি করবে না আবার রাশিয়ারসঙ্গে সম্পর্কেও সে ভাবে ক্ষত তৈরি করবে না।
বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তা ঘরোয়া ভাবে বললেন, “ট্রাম্পবাদ যখন ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে উঠছে, তখন সময় এসেছে ইইউ-র সঙ্গে ইউক্রেন-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভারতের আরও বেশি করে সংযুক্ত হওয়া। ট্রাম্প চাইছেন, গাজ়ায় প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের ধারণার উপর স্টিমরোলার চালাতে, কাউকে বাদ না দিয়ে শুল্কের নখদন্ত বার করতে, ইউক্রেনকে নিশানা করতে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের কথা বলে তিনি হয়তো আমেরিকার করদাতাদের কাছে বার্তা দিচ্ছেন। কিন্তু যে আচরণ এবং প্রকরণে তিনি এগোচ্ছেন, তাতে একটি অস্বস্তিকর শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। সেখানে কূটনৈতিক পদক্ষেপ করা প্রয়োজন। ট্রাম্পের নির্মম শুল্কনীতির হাত থেকে নয়াদিল্লিও তো রেহাই পাবে না।”
ট্রাম্প-জ়েলেনস্কির বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগেই সদ্য ভারত সফর শেষ করা ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লিয়েন তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেছেন, নয়াদিল্লির সঙ্গে তাঁরা নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা অংশীদারি শক্তিশালী করা নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, “সময় এসেছে ভারত-ইইউ কৌশলগত সম্পর্ককে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার। সেটা করা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধির জন্যই। আমরা দু’পক্ষই এক আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছি।”
আমেরিকা-ইউক্রেন বৈঠকের পরেই উরসুলা বলেছেন, “ইউক্রেন কখনওই একা নয়। তাদের ভয়হীন, শক্ত এবং সাহসী হতে হবে। আমরা অবশ্যই ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করব দীর্ঘমেয়াদি শান্তির লক্ষ্যে।” ইউরোপীয় ব্লকের নেতা কাজ়া কালাসের কথায়, “আজ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, বিশ্বের নতুন নেতা প্রয়োজন। ইউরোপের কাছে চ্যালেঞ্জ সেই দায়িত্ব নেওয়ার।” ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ বলেন, “ইউক্রেন যুদ্ধে স্পষ্টতই রাশিয়া আক্রমণকারী। আক্রমণের মুখে পড়েছেন ইউক্রেনবাসী। আমরা গোড়া থেকেই ইউক্রেনের পাশে রয়েছি।’’ ট্রাম্পকে নিশানা করে তিনি বলেন, “কেউ যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে খেলতে চান, তিনি আর কেউ নন, ভ্লাদিমির পুতিন।” জার্মানির ভাবী চ্যান্সেলর ফ্রিডরিস মেয়ার্স বলেন, “এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে কে আক্রমণকারী এবং কে আক্রান্ত, তা যেন আমরা কখনওই গুলিয়ে না ফেলি।”
স্পেন, পোলান্ড, কানাডার রাষ্ট্রনেতারাও আজ ইউক্রেনের পাশে থাকার কথা বলেছেন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)