দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী মূলত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগে আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপের ধনতান্ত্রিক দেশগুলি, অর্থাত্ প্রধানত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি, যাদের প্রথম বিশ্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হল। পরবর্তীকালে জাপানও ওই গোষ্ঠিভুক্ত হয়। আর অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের ৮টি দেশ এবং চিন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনামের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি দ্বিতীয় বিশ্ব হিসেবে পরিচিত হল। এ ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার যে সব দেশ কয়েকশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাইছিল, ভারত-সহ সেই সব দেশগুলিকে তৃতীয় বিশ্বের তকমা দেওয়া হল। ’৭০-এর দশকে এই তিনটি বিশ্ব ছাড়াও আরও একটি ‘বিশ্বে’র হদিশ দিলেন সমাজবিজ্ঞানীরা--- ‘চতুর্থ বিশ্ব’।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয় এমন ‘রাষ্ট্র’, যেখানে বসবাসকারী মানুষের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি এবং স্বাভিমান রয়েছে, আর রয়েছে স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীনতার অদম্য দাবি। যাদের প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে চরম দারিদ্রের সঙ্গে। যারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আশির্বাদ ধন্য সভ্যতার মধ্যে বা কাছাকাছি থেকেও সেই আলো থেকে বঞ্চিত। এরাই চতুর্থ বিশ্বের নাগরিক। যারা একটি রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেও নেই সেই রাষ্ট্রে। নির্দিষ্ট কোনও রাষ্ট্রের আইনকানুন মেনে চলার চাইতে নিজেদের স্বতন্ত্র নিয়ম-বিধি মেনেই জীবনযাপন করতে বেশি আগ্রহী। তাই, কোনও একটি বা দু’টি রাষ্ট্রে নয়, চতুর্থ বিশ্ব ছড়িয়ে আছে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। চতুর্থ বিশ্বের নাগরিকদের প্রায় ৯৯ শতাংশই বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ। বিভিন্ন দেশে-মহাদেশে এদের দেখা যায় মনুষ্যেতর জীবনযাপন করতে। চতুর্থ বিশ্বের বাসিন্দারা নিজেদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্বাতন্ত্র বজায় রাখছে এবং চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করছে অস্ট্রেলিয়া থেকে আফ্রিকা, এশিয়া থেকে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায়।
পৃথক জাতিসত্ত্বার এই সংগ্রামের চেহারা সর্বত্র এক নয়। ভারতে চতুর্থ বিশ্বের লড়াইও সর্বত্র এক রকম নয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির লড়াই এবং মহারাষ্ট্র থেকে পুবে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী আদিবাসীদের সংগ্রামের চেহারা এক রকম নয়। খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তাদের অনেকে স্বায়ত্বশাসন এমনকি ‘স্বাধীন রাষ্ট্রে’র মর্যাদা চায়। কিন্তু ভারতের বাকি অংশের বিশেষ করে মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগঢ়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ অংশের তিনটি জেলার আদিবাসীরা আলাদা রাষ্ট্র বা নিছক নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই বিশাল এলাকার বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চরম দারিদ্র, খাবারের অভাব, চিকিত্সা-লেখাপড়ার সুযোগের অভাবকে মূলধন করে অতি-বামপন্থীদের একটি অংশ ‘বিপ্লবের বাতাবরণ’ তৈরি করতে চাইছে। চরম দারিদ্রের মোকাবিলা করে স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলে আদিবাসীদেরও ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ করতে হবে বলে অতি-বাম কোনও কোনও রাজনৈতিক দল মনে করে। তাই, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ‘সশস্ত্র সংগ্রামে’ নিরীহ, অতি-দরিদ্র আদিবাসীদের কোথাও তির-ধনুক, কোথাও বা রাইফেল হাতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশের চতুর্থ বিশ্বের নাগরিকদের মুক্তি কী সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া সত্যিই সম্ভব নয়?
আর্থ-সামাজিক মাপকাঠিতে সারা দেশে সব ক্ষেত্রেই আদিবাসীরা সবচেয়ে নীচে পড়ে রয়েছে। সরকার নানা রকম প্রকল্পের মাধ্যমে আদিবাসীদের মূলস্রোতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং সেটাই সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করছেন। তাঁদের মতে, ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দেওয়াটা বড্ড জরুরি।
চতুর্থ বিশ্বের প্রকৃত চেহারা কী এবং কী ভাবেই বা ওই বিশ্বের বাসিন্দাদের ওপরের দিকে তুলে আনা যায় বা ‘সভ্য’ করা যায় তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। নির্মম সত্যিটা হল, অতি-দারিদ্র এবং বঞ্চনা কিছুতেই শান্তি দিতে পারে না। আর চতুর্থ বিশ্বের গোড়ার কথাই হল, অস্বাভাবিক দারিদ্র এবং মূলস্রোতের নাগরিক সভ্যতার আগ্রাসে আক্রান্ত তাদের স্বাতন্ত্র জীবনযাপন। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চতুর্থ বিশ্বের বাসিন্দারা হাত ধরেছে তৃতীয়, দ্বিতীয় বা প্রথম বিশ্বের এক শ্রেণির নাগরিকদের। তাই আমরা দেখতে পাই ভারতের আদিবাসীরা কোথাও খ্রিষ্টান মিশনারি বা কোথাও অতি-বাম মাওবাদীদের হাত ধরেছে। আবার আফ্রিকার সোমালিয়া, মালি বা আলজিরিয়ার অতি দরিদ্র মানুষজন শোষনের হাত থেকে মুক্তির তাগিদে হাত মিলিয়ে বসেছে ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠীর সঙ্গে। ফলে চতুর্থ বিশ্বের নাগরিকদের সংকট বেড়েছে ব-ই কমেনি। চতুর্থ বিশ্বের মুক্তি কোন পথে তার নিদান এখনও পর্যন্ত না সমাজবিজ্ঞানী, না রাজনীতিক কেউ-ই দিতে পারেনি।
দারিদ্র এবং বঞ্চনা থেকে অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে চতুর্থ বিশ্বের নাগরিকরা। তাদের বোধের যায়গাটা টলে যায়। হতদরিদ্র মানুষগুলি রাজনীতিক বা ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতের পুতুল হয়ে যায়। এটা শুধু চতুর্থ বিশ্বের নাগরিকদের ক্ষেত্রেই নয়, তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে সত্য।
ফের নিজের দেশের কথায় আসা যাক। এ দেশে চতুর্থ বিশ্বের বাসিন্দারা দু’শোটি জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে। সংখ্যা প্রায় ন’কোটি। বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী একশো’রও বেশি ভাষায় কথা বলে। আদিবাসী এলাকায় গেলে বুঝতে এতটুকুও অসুবিধে হয় না কতখানি দারিদ্র আর বঞ্চনার শিকার আদিবাসীরা। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের নামে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতারা এদের ব্যবহার করে চলেছে। কিন্তু আমাদের দেশের আদিবাসীদের তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। অন্তত কাগজে-কলমে, নথিপত্রে চোখ রাখলে তেমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের দেশের সংবিধানে আদিবাসীদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে বেশ কিছু ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা, শিক্ষার সুযোগ থেকে আদিবাসীরা যাতে কোনওভাবেই বঞ্চিত না হয় সে জন্য নানা রক্ষা-কবচেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
আদিবাসীদের সামাজিক ও অন্যান্য মৌলিক সুযোগ-সুবিধা দিতে রাজ্যগুলির হাতে বেশ কয়েকটি বিশেষ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। লোকসভা ও রাজ্যসভায় মোট আসনের সাত শতাংশ আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত। প্রত্যেকটি রাজ্যের বিধানসভাতেও আসন সংরক্ষিত রয়েছে তাদের জন্য। তবু সামগ্রিকভাবে আদিবাসীদের আর্থিক, সামাজিক বিকাশ উল্লেখ করার মতো কিছু হয়নি। উল্টে যত দিন যাচ্ছে ক্ষয় হচ্ছে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের। হাতে গোনা কয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠীর সামান্য কিছু মানুষকে আদিবাসীদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে ব্যবহার করছে মূলস্রোতের রাজনীতিকরা। সংখ্যায় অল্প হলেও আদিবাসীদের মধ্যে যারা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের অধিকাংশই নিজের জনগোষ্ঠীর সেই সব মানুষকে উপরে তুলে আনার জন্য নীচে হাত বাড়িয়ে দেয়নি। বরং, তারা ‘অভিজাতে’র তালিকায় নিজেদের নাম তুলতে বেশি আগ্রহী। আর তাদের আত্মীয়-পরিজনরা আটকে রয়েছে চতুর্থ বিশ্বের ঘেরাটোপেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy