ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় পতাকা তো আসলে একটা আশ্রয়। একটা নিরাপদ ভূখণ্ড। একটা প্রতীকও। যে প্রতীকের ব্যবহার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে হয়ে এসেছে। যেমন, বর্তমান সময়ে জাতীয় পতাকা রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এমনটাই মনে করছেন ইতিহাসবিদদের অনেকে।
ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাসের মতে, ভারতের রাজনীতির পেন্ডুলাম কখনও সাম্প্রদায়িকতা, কখনও শ্রেণিগত রাজনীতি, কখনও আবার জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকেছে। যেমন কলকাতায় সব থেকে বড় সংগঠিত সাম্প্রদায়িক গন্ডগোল হয়েছিল ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। যাঁরা সেই গোলমালে যোগ দিয়েছিলেন, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাঁদেরই অনেকে আবার ১৯১৯ সালে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। একই ভাবে ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক গন্ডগোলের আগে বাংলায় অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছিল। আবার ১৯৪৭ সালে দেশের স্বাধীনতার পরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই সেই স্বাধীনতাকে বরণও করেছিলেন। সুরঞ্জনবাবুর কথায়, ‘‘এ দেশের মানুষের বহুমাত্রিক পরিচিতি রয়েছে। এক-একটি পরিচিতি, এক এক সময়ে প্রকট হয়ে ওঠে। বর্তমানে জাতীয় পতাকা রাজনৈতিক বিরোধিতার একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।’’
পাশাপাশি অবশ্য কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলছেন যে, সম্প্রীতির এই ছবি কি কখনও কখনও কিছুটা আরোপিত হয়ে উঠছে? তা না হলে এমন প্রবল ভাবে ‘সম্প্রীতির বিজ্ঞাপন’-এর প্রয়োজন হবে কেন?
আরও পড়ুন: বিয়েবাড়ির সাজে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে নাচছেন মহিলা-পুরুষ, সঙ্গে আবার ব্যান্ডপার্টিও
যেমন গার্ডেনরিচের বাসিন্দা বছর পঁয়ত্রিশের মহম্মদ ইকবাল উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘‘কেন এত জাতীয় পতাকার ব্যবহার করতে হবে বলুন তো? আমরা কি জাতীয় পতাকা সব সময়ে ব্যবহার করি? না কি জাতীয় সঙ্গীত সব সময়ে শুনি? জাতীয় পতাকার গুরুত্ব অতি ব্যবহারে যেন হারিয়ে না যায়।’’ ইকবাল বিরক্ত, হতাশ সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় পতাকার মাধ্যমে নিজের ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দিতে দিতে। আশুতোষ কলেজের বায়োকেমিস্ট্রির পড়ুয়া তানভি সুলতানাও বলছেন, ‘‘যে কোনও জায়গায় জাতীয় পতাকা তুলে ধরা হচ্ছে। আমি ভারতীয়, এটা কেন আমাকে আলাদা ভাবে প্রমাণ করতে হবে?’’
সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক অভিজিৎ কুণ্ডুর আশঙ্কা, সম্প্রীতি তুলে ধরতে জাতীয় পতাকার অত্যধিক ব্যবহারে তার গুরুত্ব কমবে না তো! অভিজিৎবাবুর কথায়, ‘‘অনেক সময়ে এটাও দেখা গিয়েছে, মিছিলে ব্যবহৃত কাগজের জাতীয় পতাকা রাস্তায় পড়ে রয়েছে। সেটা তো কাম্য নয়। বিষয়টি যেন লঘু না হয়ে যায়।’’ যদিও ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় মনে করেন, ‘‘সকলের জাতীয় পতাকা তুলে ধরার মধ্যে জাতীয়তাবাদই প্রকাশ পাচ্ছে। তাই জাতীয় পতাকার অপব্যবহার হচ্ছে, এমনটা মনে করছি না।’’
২০০৫ সালে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সঞ্চালক মাইক ওয়ালেস ‘ব্ল্যাক হিস্ট্রি মান্থ’ সম্পর্কে আমেরিকার অভিনেতা মর্গান ফ্রিম্যানের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। বিষয়টিকে ‘হাস্যকর’ উল্লেখ করে মর্গান জানিয়েছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস শুধু একটি মাসের ইতিহাস নয়। তাঁর কথায়, ‘‘কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস হল আমেরিকার ইতিহাস।’’ মর্গানের প্রশ্নের সূত্রে সঞ্চালক তখন জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘তা হলে বর্ণবিদ্বেষ থেকে কী ভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে...?’’ মর্গানের উত্তর ছিল, ‘‘এটা নিয়ে কথা বলা বন্ধ করতে হবে। আমি আপনাকে এক জন শ্বেতাঙ্গ বলা বন্ধ করব। আপনিও আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ বলা বন্ধ করুন। আমি আপনাকে চিনব মাইক ওয়ালেস হিসেবে। আপনিও আমাকে চিনবেন মর্গান ফ্রিম্যান হিসেবে!’’
সময়ের ব্যবধান রয়েছে। রয়েছে ভৌগোলিক ব্যবধানও। কিন্তু সাম্প্রতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নাখোদা মসজিদের ট্রাস্টির সদস্য নাসের ইব্রাহিম যখন মর্গান ফ্রিম্যানের সুরেই বলেন, ‘‘আমাদের পূর্ব পুরুষেরা কয়েক শতাব্দী ধরে এ দেশে বসবাস করেছেন। হিন্দু-মুসলিম বা এ দেশে বসবাসকারী যে কোনও সম্প্রদায়ের ইতিহাস আসলে ভারতেরই ইতিহাস।’’ তখন মনে হয়, বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণি নির্বিশেষে ইতিহাসের একটিমাত্র চরিত্রই হয়তো মুখ্য হয়ে ওঠে। তা হল— মানুষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy