Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

পাক-নীতিতে আপাতত সংঘাতই পথ মোদীর

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি-মুনকে একটি চিঠি দিয়ে কাশ্মীর বিষয়ে ভারত-পাকিস্তান বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটাতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চাইলেন। শুধু তাই নয়, নালিশ করলেন পাকিস্তান আলোচনায় বসতে চাইছে, ভারতই বিনা প্ররোচনায় সীমান্তে গোলাবর্ষণ করছে। নওয়াজ শরিফের এই চিঠিকে কেন্দ্র করে সাউথ ব্লকে আজ তোলপাড় শুরু হয়েছে। তবে প্রকাশ্যে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দিয়ে বিষয়টির গুরুত্ব বাড়াতে চাইছে না কেন্দ্র।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২১
Share: Save:

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি-মুনকে একটি চিঠি দিয়ে কাশ্মীর বিষয়ে ভারত-পাকিস্তান বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটাতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চাইলেন। শুধু তাই নয়, নালিশ করলেন পাকিস্তান আলোচনায় বসতে চাইছে, ভারতই বিনা প্ররোচনায় সীমান্তে গোলাবর্ষণ করছে।

নওয়াজ শরিফের এই চিঠিকে কেন্দ্র করে সাউথ ব্লকে আজ তোলপাড় শুরু হয়েছে। তবে প্রকাশ্যে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দিয়ে বিষয়টির গুরুত্ব বাড়াতে চাইছে না কেন্দ্র। পুঞ্চ সেক্টরে জম্মু-কাশ্মীর সীমান্ত এখনও অশান্ত। দু’পক্ষের গোলাবর্ষণ অব্যাহত। দু’দেশের বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে বেরোনোর পথ নিয়ে কূটনীতিকরাই উদ্বিগ্ন। কাশ্মীর প্রসঙ্গের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা পাকিস্তানের দিক থেকে নতুন নয়। এক সময়ে রাষ্ট্রপুঞ্জকে চিঠি লিখেছিলেন প্রাক্তন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ। এ বার সে পথে হেঁটেছেন নওয়াজ শরিফ। সাউথ ব্লক স্পষ্ট বুঝছে, ইসলামাবাদের ইমরান-বিদ্রোহের পর নওয়াজ শরিফ এখন অনেক বেশি সেনাবাহিনী, আইএসআই এবং মোল্লাতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটা কোণঠাসা শরিফের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার রণকৌশল।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণের সময় নরেন্দ্র মোদী সার্কভুক্ত দেশগুলির প্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেটাকে কূটনীতির একটা প্রারম্ভিক ‘মাস্টার স্ট্রোক’ বলেই অভিহিত করেছিলেন বহু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নওয়াজ শরিফও এসেছিলেন। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক আলোচনাও হয়েছিল। যাত্রা শুরুর সময়েই নরেন্দ্র মোদী শান্তির জন্য উদ্যোগী হওয়ায় প্রশংসা পেয়েছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, এটি অটলবিহারী বাজপেয়ীর লাহৌর যাত্রার যথার্থ দ্বিতীয় অধ্যায়। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই দৃশ্যপট বদলে গেল। দিল্লিতে পাক হাইকমিশনারের সঙ্গে হুরিয়ত নেতাদের বৈঠককে কেন্দ্র করে উত্তাপ এতটাই বেড়ে গেল যে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ভারত।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে এসে বেশ কিছু কূটনীতিবিদ ও পাক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, পাকিস্তান নিয়ে ভারত সরকারের বিদেশনীতিতে এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে ‘স্ববিরোধী বার্তা।’ হয় পাকিস্তানের সঙ্গে আপাতত সংঘাতের লাইন নিয়েও এগোক ভারত, অথবা শান্তির পায়রা ওড়াক। কিন্তু এক বার যুদ্ধ আর এক বার শান্তি এই স্ববিরোধী বার্তায় পাকিস্তানও সংশয়ের মধ্যে পড়ছে। পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রগুলিও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যে ভারত কী চাইছে।

এর আগে ভারত-পাকিস্তানের প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন সতীশ লাম্বা। কিন্তু এখন কেউ নেই। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সতীশ লাম্বাকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর মতামত নেন। সতীশ লাম্বাও মোদীকে জানান, অটলবিহারী বাজপেয়ী কিন্তু প্রথমে দু’দেশের মধ্যে সংঘাতকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন (হাইট অব এসকালেশন)। পরমাণু বিস্ফোরণের পর কিন্তু সেই বাজপেয়ীই উত্তাপ কমানোর কূটনীতি শুরু করে দেন। কিন্তু এক বার সংঘাত এক বার বন্ধুত্ব-- এই ধারাবাহিকতার অভাবে লাভ হয় না।

সীমান্তের দু’দিকে বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুপ্রবেশ এবং গোলাবর্ষণ হয়। কিন্তু ভারত এবং পাকিস্তান এই দু’দিকে পাঁচ কিলোমিটার করে এলাকায় কোনও অশান্তি হলে সংশ্লিষ্ট ব্রিগেড কম্যান্ডাররাই তা সামলাবে, এই নীতিই চলে আসছে। স্থানীয় স্তরেই তা মিটিয়ে নেওয়া হয়, এমনকী কোর কম্যান্ডারকেও জানানোর প্রয়োজন হয় না। প্রত্যেক মঙ্গলবার দু’দেশের সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনের ডিজি নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করেন এবং ফ্ল্যাগ মিটিং-ও হয়। কিন্তু সীমান্তের সংঘর্ষকে কখনও দু’দেশের কূটনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা হয় না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এ বার সেটাই হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের কূটনীতিকরা ভারতকে জানিয়েছেন, নওয়াজকে ডাকার পরে শপথগ্রহণের সময় প্রথম দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন মোদী। ফলে, নওয়াজ পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে বেশ চাপের মধ্যে পড়ে যান। প্রথম বৈঠকটিকে শুধুমাত্র সৌজন্যমূলক রাখলে নওয়াজের সুবিধে হত। এর পরের বৈঠকে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ তোলা যেত। কিন্তু প্রশ্ন এটাই যে তাতে ভারতের লাভ কী? তৃতীয়ত, বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তাব ভারতই দিয়েছিল। সেই প্রস্তাব ভারতই নাকচ করল। এ ক্ষেত্রেও ভারতে নিযুক্ত পাক হাইকমিশনারকেও ইসলামাবাদ ডেকে পাঠাল। পরে পাকিস্তানের হাইকমিশনার বিদেশ মন্ত্রককে জানিয়েছেন, হুরিয়তের সঙ্গে বৈঠকে কোনও গোপন আলোচ্যসূচি ছিল না। এই ধরনের বৈঠক অতীতেও বার বার হয়েছে। বাজপেয়ী জমানাতেও হয়েছে। বাজপেয়ী-আডবাণীরাও হুরিয়তদের সঙ্গে কথা বলেছেন। যদি ভারত সরকারের আপত্তি থাকলে তা আগেই জানিয়ে দেওয়া যেত। তা হলে হুরিয়তের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করত পাকিস্তান। কারণ, ইসলামাবাদের কাছে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানাচ্ছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও আইএসআই-এর সঙ্গে নওয়াজ শরিফের বিরোধ থাকার ফলে ভারতের পক্ষে পাকিস্তান সম্পর্কে ধারাবাহিকতা রাখাটা কঠিন হয়েছে। কখনও ভারতের সঙ্গে শান্তির পথে হাঁটছেন নওয়াজ। কখনও সেনা, আইএসআই, মোল্লাতন্ত্রের চাপে উল্টো পথে যাচ্ছেন। তাই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সঙ্গে পাক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেছেন মোদী।

সেই বৈঠকে মোদী নির্দেশ দিয়েছেন, এখন আর কোনও ভাবেই শান্তি প্রচেষ্টার ধোঁকায় পা দেওয়া হবে না। আপাতত পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের লাইনই বজায় রাখতে হবে। আজও সীমান্তে সংঘর্ষবিরতি ভেঙেছে পাকিস্তান। তাই কড়া অবস্থান নিতে সমস্যাও নেই নয়াদিল্লির। মোদী সরকার সূত্রে খবর, কাশ্মীরে রাজ্যপালের শাসন প্রায় অনিবার্য। কারণ, নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সেখানে কঠিন। তবে মোদী সরকার চাইছে তাড়াতাড়ি কাশ্মীরের নির্বাচন করতে। কাশ্মীরে ভোট হওয়ার আগে পাকিস্তান নীতিতে আর কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE