Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus Lockdown

বিদেশি-আতঙ্কে বিতাড়িতদের তুলে এনে দিল্লিতে আশ্রয়, চারপাশের হুমকি সয়ে লড়ে যাচ্ছেন শুভম

মহামারির প্রকোপ যত স্পষ্ট হয়েছে বিদেশি এবং বিদেশফেরতদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব ততটাই বদলে গিয়েছে। আতিথেয়তার বদলে ভিনদেশি চোখে পড়লেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেকে।

করোনা সঙ্কটে উদ্ধার করে আনা সকলের সঙ্গে শুভম। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে সংগৃহীত।

করোনা সঙ্কটে উদ্ধার করে আনা সকলের সঙ্গে শুভম। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে সংগৃহীত।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২০ ১২:৫৪
Share: Save:

ভিটেমাটি বিক্রি করে ঢের আগেই হয়ত বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন পূর্বপুরুষেরা। তা-ও শিকড়ের টানে বার বার এ দেশে ফিরে আসেন অনেকে। কেউ কেউ আবার সম্পূর্ণ ভাবেই বিদেশি। কিন্তু অচেনাকে চেনার তাগিদে ছুটে আসেন বার বার। এ হেন শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন স্বদেশি এবং বিদেশিদের এতদিন দু’হাত বাড়িয়েই স্বাগত জানিয়েছেন এ দেশের মানুষ। হাতে ধরে এ দেশের সংস্কৃতি এবং আদব-কায়দার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে করিয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু গত কয়েক মাসে ছবিটা পাল্টে গিয়েছে অনেকটাই। মহামারির প্রকোপ যত স্পষ্ট হয়েছে বিদেশি এবং বিদেশফেরতদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব ততটাই বদলে গিয়েছে। আতিথেয়তার বদলে ভিনদেশি চোখে পড়লেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেকে। তাঁদের জন্যই মারণ রোগের বীজ এ দেশে প্রবেশ করেছে, কথায় এবং হাবেভাবে তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিপন্ন বোধ করা মানুষগুলির পরিত্রাতা হয়ে উঠেছেন এক যুবক। তাঁর নাম শুভম ধর্মশক্তু। কাকতালীয় হলেও এটা সত্য যে, ‘শুভ’ আর ‘ধর্ম’--এই দু'টি শব্দ রয়েছে তাঁর নামে। আর এই শব্দ দু’টির সার্থকতা তিনি প্রমাণ করলেন তাঁর কাজ দিয়ে।

বছর সাতাশের শুভম ধর্মশক্তু পেশায় তথ্যচিত্র নির্মাতা। হেঁটে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী যাওয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। আদতে উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা হলেও এই মুহূর্তে মুম্বইতে থাকেন। পেশা ও নেশা—দুইয়ের কারণেই সারা ভারত ঘুরে বেড়াতে হয় তাঁকে। সেই সূত্রেই সম্প্রতি ভিন্ দেশ থেকে আসা বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। জানতে পারেন, লকডাউনের জেরে না নিজের দেশে ফিরতে পারছেন মানুষগুলি, না কেউ তাঁদের মাথাগোঁজার জায়গা দিচ্ছে। তখনই তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন শুভম।

হস্টেলে এক টেবিলে বসে খাওয়া সারছেন সকলে। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে সংগৃহীত।

আরও পড়ুন: রাজ্যের প্রতিনিধির অপেক্ষায় কেন্দ্রীয় দল, করোনা পরিস্থিতি পরিদর্শন নিয়ে জটিলতা​

ভারতীয় বংশোদ্ভূত নলিকা নায়ডু যোগব্যায়াম শেখান। ২০১৯-এর অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে আসেন। তিনি জানিয়েছেন, ভারতের প্রতিটি কোণা ঘুরে দেখতে এসেছিলেন তিনি। মার্চের মাঝামাঝি জয়সলমীর পৌঁছন নলিকা। তত দিনে করোনা নিয়ে এ দেশেও তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই অবস্থায় তিন দিনের জন্য উটের পিঠে চেপে মরু অভিযানে চলে যান তিনি। তার মধ্যে যে লকডাউন হয়ে যাবে, জানতেন তা তিনি। ফিরে এসে যখন জানতে পারলেন, তখন সব কিছু পাল্টে গিয়েছে।

নলিকা জানিয়েছেন, মরু অভিযান থেকে ফিরে ২২ মার্চ, জনতা কার্ফুর দিন নিজের হোটেলে ফিরে যান তিনি। কিন্তু গিয়ে দেখেন, তাঁর ব্যাগপত্র সব বাইরে বার করে দেওয়া হয়েছে। ঢুকতে গেলে নিরাপত্তারক্ষী দিয়ে তাঁকেও বার করে দেওয়া হয়। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত হেলথ সার্টিফিকেট দেখিয়েও লাভ হয়নি। এলাকার কোনও হোটেল এবং হস্টেলই তাঁকে জায়গা দেয়নি। শেষমেশ টাকার বিনিময়ে তাঁকে শুধু বাথরুমে ঢুকে স্নান করার অনুমতি দেয় একটা হস্টেল।

সেখানেই শুভমের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় বলে জানান নলিকা। তিনি জানান, আচমকাই দরজায় টোকা শোনেন তিনি। দরজা খুলে দেখেন শুভম দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁকে সঙ্গে যেতে বলেন শুভম। জানান, তাঁর সঙ্গে এরকম আরও অনেকে রয়েছেন। ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার আগে সকলকে নিয়ে দিল্লি যাচ্ছেন তিনি। শোনামাত্রই শুভম এবং ওই দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু কী করে নলিকার খোঁজ পেলেন-- সে কথা নিজেই জানিয়েছেন শুভম।

করোনা সঙ্কটে ভিনদেশিদের আশা-ভরসা হয়ে উঠেছেন শুভম। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে সংগৃহীত।

আরও পড়ুন: কেরলে মৃত ৪ মাসের শিশু, দেশে ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত প্রায় ১৭০০​

শুভম জানান, ২২ মার্চ জনতা কার্ফুর দিন জনজাতিদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্রের কাজে জয়সলমীরে ছিলেন তিনি। সেখানে ফ্রান্স থেকে আসা কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরাল হচ্ছে। আশেপাশের সমস্ত হোটেল এবং হস্টেল থেকে চলে যেতে বলা হচ্ছে বিদেশিদের। তখনই সকলকে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন শুভম। সেই মতো নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে জয়সলমীরে আটকে পড়া বিদেশি পর্যটকদের উদ্দেশে বার্তা দেন।

সেখান থেকেই অনেকে শুভমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নলিকার সম্পর্কেও জানতে পারেন তিনি। সকলকে নিয়ে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে প্রাথমিক পরীক্ষায় কারও শরীরে করোনার কোনও লক্ষণ ধরা না পড়ায়, সকলকে নিয়ে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মতো ১০-১২ জন বিদেশিকে নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েন তিনি। ট্রেনে উঠে সুইডেন, স্পেন, চেক প্রজাতন্ত্র এবং ব্রিটেন থেকে আসা আরও বেশ কয়েক জনের সঙ্গে পরিচয় হয়।

তবে ট্রেনে উঠে পড়লেও, দিল্লিতে কোথায় ওঠা যায়, তা কেউই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। রাজধানীর বুকে পা রেখেও কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি তাঁদের। কোনও হোটেলই তাঁদের জায়গা দিতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ দিল্লি্র ‘দ্যাট স্টপ’ নামের একটি হস্টেল তাঁদের থাকতে দিতে রাজি হয়। এখন শুধু শুভম যাঁদের নিয়ে এসেছিলেন, তাঁরাই নন, আরও বেশ কিছু বিদেশি পর্যটক খুঁজেপেতে ওই হস্টেলে গিয়ে উঠেছেন। এমনও হয়েছে যে, গাড়ি-বাস না থাকায় দিল্লির অন্য প্রান্ত থেকে হেঁটেও সেখানে পৌঁছেছেন অনেকে।

এমন দুঃসময়ে শুভম এসে হাত না ধরলে, পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হতে পারত বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা পর্যটক। তিনি জানান, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে ভারতে আসেন তিনি। এতদিন কোথাও কোনও সমস্যা না হলেও, এ দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই চারিদিকের সবকিছু পাল্টে যায়। একটা সময় রাস্তা ঘাটে বেরোলেই তাঁকে ‘করোনা’ বলে ডাকতে শুরু করেন কিছু মানুষ। সবকিছু দেখে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন বলেও জানিয়েছেন ওই মহিলা।

এর থেকেও ভয়ঙ্কর কাহি্নি শোনান শুভম নিজে। জয়সলমীরে বিদেশিদের দেখে চপ্পল ছুড়ে মারার ঘটনাও রয়েছে বলে জানান তিনি। শুভম জানান, দিল্লিতে হস্টেল থেকে বেরিয়ে এটিএম-এ টাকা তুলতে গিয়েছিলেন এক যুগল। এটিএম থেকে বেরতে সেখানে তাঁদের উপর চড়াও হয় একদল যুবক। নানা ভাবে শাসাতে শুরু করে। ভয়ে ছুটে হস্টেলে ঢুকে পড়েন ওই যুগল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত হস্টেলের বাইরে পা না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা।

অতিথিদের সঙ্গে শুভম ও ধ্রুবিন। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে সংগৃহীত।

আরও পড়ুন: সেপ্টেম্বরে কি মিলবে ভ্যাকসিন, ফাইনালে অক্সফোর্ড

দিল্লিতে বড় বড় হোটেলগুলিতে যে সমস্ত পর্যটক রয়েছেন, তাঁরাও দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন শুভম। তাঁর দাবি, বড় বড় হোটেলগুলিতে খরচ অনেক বেশি। তাই লকডাউন ওঠার আগে টাকা শেষ হয়ে যেতে পারে বলে ভয় পাচ্ছেন অনেকে। আবার ছোট হোটেলগুলিতেও যে যাবেন, সেই উপায়ও নেই। সেখানে বিদেশিদের ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না।

তবে ওই সমস্ত পর্যটককে জায়গা দেওয়ার জন্য ‘দ্যাট স্টপ’ হস্টেলের মালিক ধ্রুবিন শাহকেও কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। তিনি জানান, পাড়া-প্রতিবেশিরা সারা ক্ষণ ফোন করে যাচ্ছেন তাঁকে। হস্টেল বন্ধ করে দিতে বলছেন। এমনকি পুলিশও অনেক বার এসে ঘুরে গিয়েছে। জার্মানি থেকে আসা তিন জনকে আনতে গিয়েছিলেন সম্প্রতি। কিন্তু রাস্তায় পুলিশ বাধা দেওয়ায় শেষ মেশ বড় হোটেলে তাঁদের ছেড়ে আসতে বাধ্য হন তিনি। ‘দেশদ্রোহী’ বলে অভিহিত করার পাশাপাশি পুলিশ তাঁকে লাঠিপেটা করার হুমকিও দিয়েছে বলে দাবি ধ্রুবিনের।

তবে এত কিছুর পরও দমে যেতে রাজি নন শুভম এবং ধ্রুবিন। হস্টেলের সকলের মনোবল বাড়াতে যোগব্যায়ামের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। বলিউডি সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। দলবেঁধে সকলে মিলে রান্নাবান্না করেন। ঘরদোর পরিষ্কারও করেন মিলেমিশে।একসঙ্গে থাকতে থাকতে সকলে বন্ধু হয়ে উঠেছেন বলে জানিয়েছেন ধ্রুবিন। তার মধ্যেই যে যার দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন প্রত্যেকেই। দূতাবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া বিশেষ বিমানে চেপে ইতিমধ্যে দেশেও ফিরে গিয়েছেন বেশ কয়েক জন। তবে এখনও ইনস্টাগ্রাম থেকে অনেকে যোগাযোগ করে চলেছেন শুভমের সঙ্গে। তাঁদের জন্য অনুদান জোগাড়েরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শুভম।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown Coronavirus Covid-19 Foreigners
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy