প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মান’ দিল বাংলাদেশ সরকার। বাজপেয়ীর হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের হাত থেকে সেই সম্মান গ্রহণ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। রবিবার ঢাকায়। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী।
ধানসিড়িটির তীরে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দু’দিনের ঐতিহাসিক সফর যখন শেষ করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, গোটা বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার তখন দৃশ্যতই আবেগে কাঁপছে!
উপস্থিত বাইশশো বাঙালিকে বিস্মিত করে মোদী কখনও জীবনানন্দ আবৃত্তি করছেন। কখনও তুমুল হাততালির মধ্যে বলছেন, ‘‘এর পর যখন আসব, ঠাকুর বাড়ি যাব, পদ্মায় নৌকায় বসে এখানকার তরুণদের সঙ্গে আড্ডা মারব!’’ কখনও বা পরিষ্কার বাংলায় তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমার বাংলা কেমন বলো তো?’’ সন্ত্রাসবাদ দমন থেকে তিস্তা, বাণিজ্যঘাটতি থেকে শক্তি-সহযোগিতা— যাবতীয় দ্বিপাক্ষিক দীর্ঘমেয়াদি অসুখগুলিকে চিহ্নিত করে ফের সেই বাংলাতেই বলছেন, ‘‘আমার বাংলাদেশের ভাইবোনেরা, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। তোমাদের সঙ্গে নিয়ে চলব!’’
যে ভাষার জন্য এই দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে, আজ তাকেই আয়ুধ হিসাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করে দিল্লি ফেরার বিমানে উঠলেন নরেন্দ্র মোদী।
কূটনৈতিক শিবির বলছে, এই সফরে এক দিকে স্থল সীমান্ত চুক্তিকে রূপায়িত করে দু’দেশের সরকারের মধ্যে উন্নয়নের লকগেট পুরোদমে খুলে দিলেন মোদী। অন্য দিকে, এই দেশে বহু ব্যবহৃত ভারত-বিরোধিতার তাসটির জেল্লাও অনেকখানি ম্লান করে দিতে পেরেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
আজই দুপুরে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করার পর সেই দলের শংসাপত্র কুড়িয়েছেন, যা অতীতে কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রনেতার কপালে জোটেনি। মোদী-খালেদা বৈঠকের পর বিএনপি-র মুখপাত্র মঈন খান জানিয়েছেন, ‘‘জনাব মোদী গণতন্ত্রের পূজারি। সে জন্যই তৃণমূল স্তর থেকে উঠে এসে আজ এখানে পৌঁছনো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে।’’ আবার সেই মোদীরই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেছেন— ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্যই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
সন্ত্রাস-বিরোধিতা এবং উন্নয়নকে আজ একই মুদ্রার দু’পিঠের মতো ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বার্তা দিয়েছেন মোদী। পাশাপাশি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে বারবার সেই স্মৃতিকে ফিরিয়ে এনেছেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমার এক আবেগের যোগ রয়েছে। আমার রাজনৈতিক কার্যকলাপের হাতেখড়ি হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সত্যাগ্রহ করে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে। সে সময়ে কাগজে মুক্তিযুদ্ধের খবর পড়ে, অত্যাচারের কথা শুনে আপনাদের যেমন রক্ত গরম হতো, তেমনটা আমারও হতো!’’
গত কালই সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’-এর ডাক দিয়েছিলেন হাসিনা। আজ তাঁর সেই প্রতিশ্রুতিকে ধ্রুবপদের মত বারবার নিজের বক্তব্যে ফিরিয়ে এনেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, ‘‘এক জন মহিলা হয়েও যে ভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসের প্রশ্নে জিরো টলারেন্সের ডাক দিয়েছেন, তাঁর হিম্মতকে আমি সম্মান জানাই। ওঁর সঙ্গে আমার চিন্তা খুবই মিলে যায়। উনিও বিকাশের কথা ভাবেন, আমিও তাই।’’ অন্য দিকে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কখনও নাম করে, কখনও নাম-না করে পাকিস্তানকে নিশানা করতে ছাড়েননি তিনি। সন্ত্রাস বিরোধিতার প্রশ্নে শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করে ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদকে তীব্র আক্রমণ করে বলেছেন, ‘‘আমরা যে সম্প্রদায়েরই হই না কেন, ঈশ্বর-আল্লা যাতেই বিশ্বাস করি না কেন, মানবিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবার এক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘পাকিস্তান আমাদের সারা ক্ষণ বিব্রত করে রেখেছে। সন্ত্রাসের হুমকি দিচ্ছে। অথচ ৭১-এর যুদ্ধের সময় আমরা ৯০ হাজার পাক সেনাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিলাম। ভারত কিন্তু সে দিন তাদের উপর গুলি চালায়নি। আর আজকাল একটা বিমান ছিনতাই করেই কত কী চাওয়া হয়!’’
স্থল সীমান্ত চুক্তির রূপায়ণই যে ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশকে দেওয়া শেষ উপহার নয় বরং শুরু, সে কথা আজ বিভিন্ন সময়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত কালের থেকেও জোরালো ভাষায় এ দিন তিস্তা জল বণ্টন নিয়ে নিজের প্রত্যয় তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষের সামনে। বলেছেন, ‘‘জল কোনও রাজনৈতিক বিষয় নয়, মানবিকতার বিষয়। আমরা সবাই মিলে এর সমাধান করব। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্বাস হারালে চলবে না!’’ এই সফরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে পাওয়ার কারণে নিঃসন্দেহে তিস্তা প্রসঙ্গে মোদীর আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। এ কথাও মোদী আজ বলেছেন, ‘‘আমার এই ৪০ ঘণ্টার সফরে আমি সব সমস্যা মিটিয়ে চলে যাব, এটা ভাবা ভুল। অনেক রাজ্য আমাদের দেশে। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে চলব ঠিকই, কিন্তু রাজ্যগুলিকে নিয়েও তো আমাকে চলতে হবে!’’
আজ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে দীর্ঘ যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও রয়েছে তিস্তা চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করার আশাবাদ। পাশাপাশি দু’দেশের মধ্যে অবিশ্বাসের ছায়া তৈরি করা টিপাইমুখ জলবিদু্ৎ প্রকল্প কার্যত খারিজ করার কথা বলা হয়েছে। ঘোষণাপত্রের ভাষায়, ‘‘ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy