নরেন্দ্র মোদী।
টানা পঁচিশ বছর ‘জান লড়িয়ে’ কাজ করার পরে এ বার দীপাবলির মুখে ‘মোটা বোনাস’ হাতে পেয়েছেন দামোদর মহেশ্বরী। ছাঁটাইয়ের চিঠি!
গুরুগ্রামের যে গাড়ি-যন্ত্রাংশ কারখানার দরজা দামোদরের জন্য আচমকা বন্ধ হয়ে গেল, বিকেলে তার গেটের সামনে কর্মীদের জটলা। রাম নিবাস যাদব, মনোজ কুমার, দলসিংহ যাদব, দিকপাল সিংহ রানারা বলছিলেন, গত কয়েক মাসে শুধু গুরুগ্রামেই কাজ গিয়েছে অন্তত দু’লক্ষ কর্মীর। মানেসরে আরও প্রায় এক লক্ষ। অধিকাংশই ঠিকা শ্রমিক। কাজ যাওয়ার পরে বেশির ভাগই সস্তার ভাড়া-ঘরে থাকার টাকাও জোগাড় করতে পারেননি। ফিরে গিয়েছেন নিজের রাজ্যে, গ্রামে। অনেকের ঘরে ছেলেমেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। কিছু বাড়িতে গুনতি কমেছে রাতের মাথাপিছু রুটির। কাজ হারানোর নিত্য উদ্বেগ কিছুটা ‘গা সওয়া হয়ে আসা’ কর্মীদের আক্ষেপ, এ বার দীপাবলির রোশনাই তাঁদের উঠোনে নেই। দূর-দূরান্তেও খোঁজ নেই গাড়ি শিল্পে আশার আলোর। অতএব, ‘ছাঁটাই চলছে, চলবে।’
পুরো তল্লাটে কর্মীদের চোখেমুখে যখন ভয়, সামনে দিয়ে ছুটে যাওয়া অটোরিকশ মনে করিয়ে দিচ্ছে, বিপুল জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। পদ্মফুলের পতাকায় মোড়া অটোর মাথায় বসানো মাইক নাগাড়ে বলে চলেছে, ‘অব কি বার, পঁচাত্তর পার।’ অর্থাৎ, হরিয়ানা বিধানসভার ৯০টি আসনের মধ্যে ৭৫টিতে জয়ের গন্ধ পাচ্ছে বিজেপি। ভোট-প্রচারে এসে রাহুল গাঁধী দাবি করেছেন, অর্থনীতি রসাতলে। বেকারত্ব আকাশছোঁয়া। সে সব প্রসঙ্গে না-ঢুকে শুধু কাশ্মীর আর ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদে মানুষের মন মজাতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী। এক দিন সেই ফাঁকি ধরা পড়বেই। কিন্তু সেই দিন যে কবে, তা খোদ রাহুলের বক্তৃতাতেও ঠাওর করা শক্ত।
হরিয়ানার জনসভায় মোদী পাকিস্তানকে পাল্টা দেওয়ার কথা বললে কিংবা কাশ্মীরের কথা তুললেই থামতে চাইছে না হাততালি। স্থানীয় মানুষও মানছেন, এ বারের ভোট প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিংহ হুডার অগ্নিপরীক্ষা হওয়া সত্ত্বেও ছত্রখান দেখাচ্ছে কংগ্রেসকে। স্থানীয়দের কথায়, ‘দম নেহি হ্যায়।’ আর বিজেপিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারত যাঁর দল, সেই ওমপ্রকাশ চৌটালা দুর্নীতির দায়ে জেলে। কার্যত মুষলপর্ব চলছে তাঁর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদলে। চৌটালার নাতি দুষ্মন্ত ময়দানে নেমে সাড়া ফেলেছেন ঠিকই তবে মিষ্টির দোকানিরা আশায় রয়েছেন— কম বিক্রিবাটা পুষিয়ে দেবে গেরুয়া শিবিরের ভোটজয়ের লাড্ডুর বরাত। আর রাস্তার মোড়ের ভিড় খোলাখুলি বলছে, “পেট চালানো দায় ঠিকই। কিন্তু মোদী ছাড়া আর আছেন কে? পদ্মে বোতাম টিপলে হরিয়ানার কী লাভ হবে জানি না। কিন্তু দিল্লিতে হাত শক্ত হবে মোদীর।”
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো মিনি ট্রাকে বিজেপির বড় ব্যানার —‘ভ্রষ্টাচার পর কড়া প্রহার, বিকাশ হমারা হ্যায় অধিকার’। আর তার থেকে কয়েকশো গজ দূরে দাঁড়িয়েই বিড়বিড় করছেন সতীশ সিংহ, “৮-১০টা ট্রাক আছে আমার। এখন ঠায় দাঁড়িয়ে। এমনিতে যেখানে মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ভাড়া মেলে, এখন মেরেকেটে হাজার দশেক। ঋণের কিস্তি, বিমার প্রিমিয়াম, চালকের বেতন কোথা থেকে দেব বলুন তো?”
গবেষণা ও উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-র রিপোর্ট বলছে, গত অগস্টে হরিয়ানায় বেকারত্বের হার ২৮.৭%। সারা দেশে সব থেকে বেশি। দেশের গড় বেকারত্বের হারের (৮.৪%) তিন গুণেরও বেশি। স্থানীয় গাড়ি এবং যন্ত্রাংশ সংস্থার কর্মীদের জিজ্ঞাসা করলেই তাঁরা বন্ধ হওয়া সংস্থার (এক বা একাধিক ইউনিট) নাম বলে যাচ্ছেন গড়গড়িয়ে। ওম্যাক্স, এনডিওরেন্স, নোপিনো...। সন্দীপ কুমার, ধীরেন্দ্র গুপ্ত, চন্দন সিংহ, প্রবীণ জানোরা, মনোজ প্রধানদের দাবি, সপ্তাহে সাত দিন সমস্ত শিফ্ট চালু রাখছে না মারুতি, হিরোর মতো বড় সংস্থাও। কমবয়সিদের কাজ তো যাচ্ছেই। মধ্য চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশে কাজ খুইয়ে আত্মহত্যার চিন্তাও মাথায় আসছে অনেকের। তাঁদের ক্ষোভ, “বাজার খারাপ ঠিকই। কিন্তু তার সুযোগে আরও বেশি করে কর্মী ছাঁটাই করছেন মালিকেরা। তা রুখতে সরকারের মাথাব্যথা নেই। উল্টে বিক্ষোভ দেখাতে গেলে জুটছে লাঠি।”
গুরুগ্রামের কর্মীদের অন্তত ৬০-৬৫ শতাংশ ভিন্ রাজ্যের। যাঁরা হরিয়ানার, তাঁদের ৯০ শতাংশের ভোটও অন্য বিধানসভায়। আবার যাঁরা এখানে ভোট দেবেন, তাঁদের বড় অংশ মজে মোদীজির ‘কলজের জোরে’। হাওয়া বুঝে বিজেপি ফুরফুরে, তবে সাবধানীও। ২০১৪ সালেই এ রাজ্যে তারা প্রথম একক ভাবে ক্ষমতায় এসেছে। আর রাজ্যের সব চেয়ে বেশি মানুষ যে গোষ্ঠীর, সেই জাঠ মুখ নন মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর। তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভও যথেষ্ট। তবু পঁচাত্তর পারের স্লোগান তুলছে তারা। ‘চাকরিখেকো’ গুরুগ্রামে মাইক থেকে ছিটকে আসছে গান—‘লো ভাইয়া, অচ্ছে দিন আ গ্যয়ে’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy