নিজের হস্টেলের সামনে কানুপ্রিয়া। নিজস্ব চিত্র
ওই যে ওই ছেলেগুলোকে দেখছেন? বসে বসে গোঁফে তা দিচ্ছে! ওরা কিন্তু পড়ে না এখানে! শুধু দামি জামাকাপড় পরে, দামি গাড়ি নিয়ে চলে আসে আর মেয়েদের দিকে বিচ্ছিরি ভাবে তাকিয়ে থাকে! কাক্কাশাহি কালচার বলি এটাকে আমরা!
চণ্ডীগড়ে পাতা ঝরার মরসুম শেষ হয়নি এখনও। পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস সেন্টার লাগোয়া ক্যান্টিনের দিকে ইশারায় দেখালেন কানুপ্রিয়া। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের এই বামপন্থী ছাত্রীটি পিইউ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিতে আসা প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। কানু প্রিয়া এবং তাঁর সংগঠনএসএফএস-এর নেতৃত্বেই টানা ৪৮ দিন ধর্না আন্দোলন চালিয়ে পিইউ-এর মেয়েরা হস্টেল জীবনে স্বাধীনতা আর সমানাধিকার আদায় করেছেন।
গাঁধী ভবনের সামনে থেকে বাঁয়ে ঘুরে বিভাগীয় লাইব্রেরিতে বই ফেরত দিতে যাচ্ছেন তর্ণতারণ থেকে পড়তে আসা কানু। ‘‘আমাদের মূলধারার সংস্কৃতিটা ভাবুন এক বার! পঞ্জাবি গান শুনে দেখুন! তুমি আমার জিপগাড়ি, তুমি আমার ছিপিবন্ধ মদের বোতল— এ সবও লিরিক!’’ সেই আবহের মধ্যে দাঁড়িয়েই ‘পিঁজরা তোড়’, সেখানেই অধিকার বুঝে নেওয়ার ডাক!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
চণ্ডীগড়, পাটিয়ালা, হোশিয়ারপুর— দিকে দিকে ‘অবাধ্যতার ঢেউ’ কাঁপিয়ে দিয়েছে পঞ্চনদের অববাহিকাকে। মেয়েরা ক্যাম্পাসে মিছিল করছেন, স্লোগান দিচ্ছেন, ওড়নায় মুখ না ঢেকেই সব রকম প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন— ক’বছর আগেও পারতপক্ষে ভাবা যেত না এ সব।
লাইব্রেরির রিডিং রুম বরাবর খোলা থাকে রাতে। ছেলেরা যখন খুশি পড়তে যেতে পারত, মেয়েরা নয়। পরীক্ষার আগে আলাদা পারফর্মা সই করিয়ে তবে অনুমতি মিলত।
কানুপ্রিয়াদের প্রশ্ন ছিল, যদি বিষয়টা নিরাপত্তারই হয়, তবে ওই এক টুকরো কাগজ কী নিরাপত্তা দেবে? নিরাপত্তা দেওয়া তো বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব! তার বদলে মেয়েদের উপর ‘কার্ফু’কেন? দিনের বেলাই কি ক্যাম্পাস নিরাপদ নাকি?
২০১৫ সালে সেক্টর ১৭-র এই ক্যাম্পাসেই একটি মেয়েকে জিপ নিয়ে তাড়া করেছিল কিছু যুবক। তখন যৌন হেনস্থা সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর সেল পর্যন্ত ছিল না। সেল তৈরি আর ক্যাম্পাসে অবাধ গাড়ি ঢোকা নিয়ন্ত্রণ করার দাবিতে শুরু হল আন্দোলন। গাড়ি নিয়ে চক্কর কাটা, মেয়েদের ফলো করা, কটুকাটব্য করাটা ও অঞ্চলে যেন জলভাত। গাড়ি নিয়ে দৌরাত্ম্য একটা রোজকার আপদ। পিইউ সেই প্রথম দেখল, চার-পাঁচশো মেয়ের মিছিল। তাদের দাবি মেনে সেল চালু হল। গাড়িতে রাশ টানার আশ্বাসও মিলল। তবে তা কার্যকর করা নিয়ে টালবাহানা আজও চলছে।
গাড়ি ঢোকা নিয়ে অসন্তোষ, যৌন হিংসা-প্রতিরোধী সেল তৈরি আর হস্টেল থেকে ঢোকা-বেরোনোর স্বাধীনতা— ঠিক এই তিনটে দাবি নিয়েই আন্দোলন পাটিয়ালার পঞ্জাবি বিশ্ববিদ্যালয়েও। ২০১৫ সালে শবরীমালার ব্যাপারে ‘হ্যাপিটুব্লিড’ স্লোগান তুলে হইচই ফেলে দেওয়া নিকিতা আজাদ এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী ছিলেন। ২০১৩ থেকে পাটিয়ালা ক্যাম্পাসে ডিএসও নামে একটি বামপন্থী সংগঠন মেয়েদের অধিকার নিয়ে সরব হতে শুরু করে। মেয়েদের জন্য আন্দোলনে মেয়েরা কোথায়? প্রশ্ন উঠত গোড়ায়। ২০১৪ থেকে সংগঠনে মেয়েরা যোগ দিতে শুরু করলেন, ক্রমে সতপাল-অমরজিৎ-আজাইবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যশপ্রীত, কমলজিত, রুপিন্দরদের মতো লড়াকু নেত্রী উঠে এলেন। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লাগাতার সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে সেল তৈরির দাবি আদায় করে ছাড়লেন ওঁরা। দীর্ঘ আন্দোলন করে ক্যাম্পাসে গাড়ি ঢোকা বন্ধ করালেন। হোলিতে হস্টেলের মেয়েদের বন্দিদশা ঘোচালেন। বঙ্গীয় ছাত্র রাজনীতি চমকে উঠতে পারে, এত কিছু ঘটে গেল কিন্তু ছাত্র সংসদের উপস্থিতি ছাড়াই। কেন্দ্রশাসিত চণ্ডীগড়ের পিইউ বাদ দিলে খাস পঞ্জাবে সেই ১৯৮৪ থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ। ২০১৭-য় ক্ষমতায় এসে কংগ্রেস খাতায়কলমে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়েছে। কিন্তু ভোট আজও হয়নি।
ক্যাম্পাসের ভগৎ সিংহ চকে বসে চা খেতে খেতে যশপ্রীত, অমরজিৎরা বললেন, ‘‘২০১৬-য় আমাদের আন্দোলনের জেরে হস্টেলের দরজা খোলা থাকার সময় দু’ঘণ্টা বাড়ানো সম্ভব হয়। প্রতিশ্রুতি মিলেছিল, প্রত্যেক বছর এক ঘণ্টা করে সময় বাড়বে। কিন্তু ২০১৮-তে যেই আবার জিজ্ঞাসা করলাম যে, সময় কেন বাড়ছে না তখন দেখা গেল, ওঁদের আসলেই কোনও ইচ্ছা নেই।’’
তার পর? গত বছর ৪ অক্টোবর রাতে পাটিয়ালা ক্যাম্পাসে সাতটা হস্টেলের দরজা ভেঙে মেয়েরা বাইরে বেরিয়ে এলেন। ৯ তারিখ বহিরাগত গুন্ডা, অন্য একটি ছাত্র সংগঠন এবং শাসকগোষ্ঠীর প্রায় ৩০০ লোক লাঠি, রড নিয়ে চড়াও হল। হস্টেলের সামনে মেয়েদের যাকে পেল মারল। রণক্ষেত্র হয়ে উঠল ভিসি অফিস। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাঁচ দিন ছুটি ঘোষণা করে দিলেন কর্তৃপক্ষ। পরে জানানো হল, এখন থেকে রিসার্চ স্কলারদের হস্টেল ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকবে। ছাত্রীদের হস্টেল থেকে বেরনোর সময় রাত ন’টা আর ঢোকার সময় বাড়িয়ে রাত দশটা করা হচ্ছে!
চণ্ডীগড়ের হস্টেলে খাঁচা ভাঙার ডাক প্রথম দিয়েছিলেন যিনি, তিনি কিন্তু বাণী সুদ। বিজেপি-মনস্ক মেয়েটি ২০১৭-য় কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের হয়ে জেনারেল সেক্রেটারি পদে জেতেন। প্রথমে ব্যাক আপ প্রার্থী হিসেবে মনোয়ন জমা দিয়েছিলেন। নিজে বাড়িতে জানানোর আগেই ‘উপকারীরা’ ফোন করে জানিয়ে দিলেন, ‘‘মেয়ের খোঁজ রাখেন? জানেন সে ভোটে দাঁড়াচ্ছে!’’ আজও সে কথা মনে করে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে বাণীর। বলেন, ‘‘আমি হয়তো শেষ অবধি দাঁড়াতাম না। ওই ফোনগুলোই রোখ বাড়িয়ে দিল।’’
হস্টেলে তখন নিয়ম, রাতে বেরোলে ভোর ৫টার আগে ঢোকার দরজা খুলবে না। রাত ৯টার মধ্যে বেরোতে হবে। রাত ৯টা ৫ হয়ে গেলেই চিচিং বন্ধ। বাণীর খুবই গোলমেলে লাগত বিষয়টা। গত বছর ২১ মার্চ স্টুডেন্টস সেন্টারের র্যাম্প থেকে একটা মাইক নিয়ে বাণী ঘোষণা করলেন, সব ক’টা হস্টেলে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন। ‘‘দিল্লির পিঁজরা তোড় আন্দোলন সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা ছিল। ওই নামটা এখানেও ব্যবহার করলাম।’’ কিন্তু বাণীর ভাবনাটা কার্যত ছিনতাই করে নিয়ে অনশনে বসে যায় অকালি সমর্থিত একটি ছাত্র সংগঠন। বাণী বলেন, ‘‘আসলে কোনও মেয়ে এই কৃতিত্ব অর্জন করবে, এটা কেউ মানতে পারেনি। আমার নিজের সংগঠনও বলেছিল, আমাদের বলোনি কেন! তাদের বোঝাতে পারিনি, আমি যা করেছি ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি হিসেবে করেছি, দলের হয়ে নয়।’’
বাণীর উদ্যোগে সে বার ঘণ্টা দুয়েক সময় বেড়েছিল মেয়েদের জন্য। কানুপ্রিয়া জিতে এসে বললেন, ‘‘আমরা ২৪/৭-এর স্বাধীনতা চাই।’’ কথায় কাজ হল না। অক্টোবরের শেষ থেকে ৪৮ দিন ধরে ওঁরা দল বেঁধে হস্টেলের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে বসে পড়লেন। ওখানেই তোষক পেতে ঘুমোলেন। ওখানেই ঝড়বৃষ্টি গেল, পরীক্ষা গেল। দেওয়ালি-গুরুপুরবের উৎসব গেল। মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন সবাই। রাতের নিশুতি ক্যাম্পাস গমগম করে উঠল নারীকণ্ঠের স্লোগানে।
পঞ্জাবে শুকনো পাতা ঝরা শেষ হয়নি এখনও। সবুজের অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy