Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

চাষির কান্নায় চিনিতেও নুন

গত বছর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে জেডি(এস) নেতা এইচডি কুমারস্বামী এই এলাকায় ‘অভিনন্দন সমারোহ’-তে এসেছিলেন।

এক আখচাষি।

এক আখচাষি।

সুব্রত বসু
মান্ডিয়া শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:০৯
Share: Save:

এখানে আখের স্বাদ নোনতা!

বেঙ্গালুরু শহর থেকে ঝাঁ-চকচকে সড়ক ধরে মহীশূরের দিকে শ’কিলোমিটার এগোলেই সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা— ওয়েলকাম টু সুগার সিটি মান্ডিয়া। জাতীয় সড়ক ছেড়ে সরু রাস্তা ধরে আর বিশ কিলোমিটার গেলেই দুধ্ধাহোবলি গ্রাম। সেখানেই থাকে জয় কুমারের পরিবার।

কে জয় কুমার?

গত বছর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে জেডি(এস) নেতা এইচডি কুমারস্বামী এই এলাকায় ‘অভিনন্দন সমারোহ’-তে এসেছিলেন। নভেম্বরের ২৩ তারিখের সেই সকালেই আখচাষি জয় বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মরার আগে ১৫ বছরের মেয়ের রক্ষিতার স্কুলের খাতা থেকে সাদা পাতা ছিঁড়ে মুখ্যমন্ত্রীকে একটা চিঠি লিখেছিলেন ৪৪ বছরের জয়।

মেয়ে ও ১২ বছরের ছেলে রাজেশকে পাশে বসিয়ে জয় কুমারের স্ত্রী হেমলতা বলেন, “তিন-চার বছর ধরেই ধার নিতে হচ্ছিল সমবায় ব্যাঙ্ক ও মহাজনের কাছ থেকে। ধারের বোঝা বাড়তে বাড়তে ৫ লক্ষ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে উনি লিখেছিলেন, আমাদের বাঁচান। চাষিরা আর টানতে পারছে না।”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

শুধু মান্ডিয়ায় নয়, কর্নাটকের মধ্য এবং উত্তরের প্রায় সব ক’টি জেলার চাষিদের একই হাল। রাজ্যের ১৭৬টি তালুকের মধ্যে ১৫৬টিকে সরকার খরা কবলিত ঘোষণা করেছে। এই সব এলাকায় চাষিদের আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। রাজ্য রায়ত সঙ্ঘের নেতা রাজন বলেন, “সরকারি তথ্য বলছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে অগস্ট পর্যন্ত এ রাজ্যে প্রতি ১২ ঘণ্টায় এক জন করে চাষি আত্মহত্যা করেছেন। ওই পাঁচ মাসে মোট আত্মহত্যার সংখ্যা ২৮৩। চাষিদের গড় ধারের পরিমাণ মাথাপিছু ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। তবে এটা ব্যাঙ্কের হিসেব। মহাজনের ধারের সঠিক তথ্য সরকারের কাছেও নেই।”

যেমন জয় কুমারের ধারের হিসেব। হেমলতা বলেন, “মোট ৫ লক্ষের মধ্যে মাত্র দেড় লক্ষ সমবায় ব্যাঙ্কের। বাকিটা মহাজনের। এরা মাসে ৪ টাকা হারে সুদ নেয় (বছরে ৪৮ শতাংশ)। ধারের টাকা লাফিয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যায়।”

এ ভাবে আর টানতে পারছেন না জয় কুমারেরা। এক দিকে খরা। অন্য দিকে ফসলের দাম নেই। রাজন বলেন, “চিনিকলের মালিকরা এক টন আখের দাম ঠিক করেছেন ২৩৬০ টাকা। পরিবারের সবাই মিলে খেটেও এই দামে এখন আর আখ ফলানো সম্ভব নয়। কৃষক আত্মহত্যার তালিকায় কর্নাটকের নাম মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানার পরেই।”

এই অবস্থায় চাষিদের ভরসার জায়গা ছিল কুমারস্বামীর সরকার। পাঁচ মাস আগেও কর্নাটকে লোকসভার তিনটি আসনের উপনির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। তিনটির মধ্যে তাদের ঝুলিতে এসেছে মাত্র একটি। কুমারস্বামী চাষিদের ঋণ মকুবের জন্য ৪২ হাজার কোটি বরাদ্দের কথাও ঘোষণা করেছেন। তাতে কি কিছু সুরাহা হয়েছে চাষিদের?

রাজন বলেন, “সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে থেকে যাঁরা ঋণ নিয়েছিলেন, তাঁদের একাংশ সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু টাকা মকুবের পদ্ধতি এত জটিল যে, অনেক চাষিই তা করে উঠতে পারছেন না।” এলাকার আর এক আখচাষি ভাসু রাজ বলেন, “মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ তো আছেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চিনিকল মালিকদের একাংশের অত্যাচার। এঁদের বেশির ভাগই বছরের পর বছর নানা অজুহাত দিয়ে ফসলের দাম মেটাচ্ছেন না। অথচ ওঁদের কাছে আখ বিক্রি করা ছাড়া আমাদের কোনও উপায়ও নেই। ফসল বিক্রি করেই যাতে আমরা সঙ্গে সঙ্গে পুরো টাকাটা পেয়ে যাই, সরকার সে বিষয়ে নজর দিচ্ছে না।”

আখের দাম টন পিছু অন্তত ৩ হাজার টাকা করা এবং বিক্রির টাকা সঙ্গে সঙ্গে চাষিদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে রায়ত সঙ্ঘ আন্দোলনও করেছে। কিন্তু মহারাষ্ট্রের নাশিকের পেঁয়াজ চাষিদের মতো সেই আন্দোলন সেভাবে দানা বাঁধেনি কর্নাটকে। কেন? মান্ডিয়ার সমাজকর্মী হেমন্থ বলেন, “আসলে এ রাজ্যে সুগার-লবি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। প্রায় প্রতিটি চিনিকলের মালিকই কোনও না রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অনেকে শাসক দলের মন্ত্রীও। এঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে, এমন সাধ্য কার!”

আখ ফলিয়ে তাই ফি বছর চোখের জল ফেলে আত্মহত্যা করছেন শয়ে শয়ে চাষি। তার পর? মান্ডিয়ার সুনকাথান্নুর গ্রামের আখচাষি নন্দিশের আত্মহত্যার পরদিনই দুই শিশুসন্তান চন্দনা ও মনোজকে বিষ খাইয়ে আত্মহত্যা করেছেন তাঁর স্ত্রী কমলাও। কৃষকের আত্মহত্যার তালিকায় অবশ্য কমলা ও তাঁর শিশুদের নাম ওঠেনি। উঠবেও না, কারণ তাঁরা কৃষক নন! তালিকার বাইরেও এলাকার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে এ রকম অনেক অনেক নাম।

সেই কবে ছাত্রজীবনে হাতে এসেছিল লাতিন আমেরিকার পটভূমিকায় সৌরীন সেনের লেখা বই ‘আখের স্বাদ নোনতা’। তার পর কত দশক ধরে কাবেরী নদী দিয়ে কত জল বয়ে গিয়েছে। কিন্তু কর্নাটকের সুগার সিটিতে এখনও আখের স্বাদ সেই নোনতাই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy