স্বপ্ন সফল! চিন যুদ্ধের সময় বিচ্ছিন্ন হওয়া বাবা-মার সঙ্গে ৫৪ বছর পর দেখা হল লিনঝি লিয়াং ওরফে প্রমীলা দাসের।
মেয়ের হাতে তখন বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ফরমায়েসি জিনিসের ঝুলি। চোখে জল। এ জীবনে মেয়েকে ফের দেখার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন ৯১ বছর লিলং কোখোই, স্ত্রী চানু। সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দিলেন ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের চেয়ারম্যান রীতা চৌধুরি এবং তিনসুকিয়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
ভারত-চিন যুদ্ধের সময় পরিবার-বিচ্ছিন্ন চিনাদের একটি অংশ থেকে গিয়েছেন অসম ও উত্তরবঙ্গে। তাঁদের নিয়ে বই লিখেছিলেন সাহিত্যিক রীতাদেবী। সেই ‘মাকাম’ বইয়ের সূত্র ধরেই আলোয় আসে চিন যুদ্ধের সময়কার অন্ধকার অধ্যায়। রীতাদেবী বলেন, ‘‘ইংরেজ আমল থেকে অসম ও বাংলায় আসা চিনারা স্থানীয়দের বিয়ে করে সেখানকার ভাষা-সংস্কৃতি আপন করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় চর সন্দেহে চিনাদের কয়েক জনকে বিতাড়নের ঘটনা অনেক পরিবারকে চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন করে দেয়।’’
অসম ও উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকায় থেকে যাওয়া চিনা পরিবারগুলির সেতুবন্ধনের লড়াই চালাতে থাকেন রীতাদেবী। নিজে হংকং গিয়ে অনেক পরিবারের যোগসূত্র খুঁজে বের করেন। ‘স্কাইপ’-এর সাহায্যে বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলির মধ্যে ফের যোগাযোগ হয়। তখনই জানা যায় প্রমীলাদেবীর গল্প।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা চাষের জন্য নিয়ে এসেছিল লিলংকে। চানু ছিলেন লুসাই উপজাতির মহিলা। ১৯৬২ সালে, প্রমীলাদেবীর বাবা-মা ও দুই ভাইকে তিনসুকিয়ার মাকুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। তখন অবশ্য প্রমীলাদেবীর নাম ছিল লিনঝি লিয়াং। বাবা আদর করে স্থানীয় নাম ‘প্রমীলা’ যোগ করেছিলেন। ছ’বছরের লিনঝি ওই সময় ঠাকুরমার বাড়ি থাকায় পুলিশের হাতে পড়েনি। তখন থেকে ঠাকুরমার কাছেই মানুষ লিনঝি। ভয়ে নামের চিনা অংশ বাদ দেন ঠাকুমা। এখন প্রমীলার বয়স ৬০। তাঁর সঙ্গে কেহুং চা বাগানের গাড়িচালক সিমন দাসের বিয়ে হয়। ছেলে জনও বর্তমানে ওই বাগানেই গাড়িচালক।
প্রমীলাদেবী জানান, ১৫ বছর আগে চিন থেকে বাবার চিঠি আসে। বাবা জানান, জাহাজে তাঁদের চিনে পাঠানো হয়েছে। চিনে গিয়ে লিলং-চানুর আরও পাঁচ সন্তান হয়। কিন্তু বড় মেয়েকে ভুলতে পারেননি তাঁরা।
প্রমীলাদেবীর সঙ্গে তাঁর বাবা-মায়ের দেখা করানোর জন্য রীতাদেবী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের দ্বারস্থ হন। কেন্দ্র চিনে যাওয়ার অনুমতি দিলেও টাকা জোগাড় হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনসুকিয়ার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সূর্যোদয়’ আর রীতাদেবী প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ টাকা জোগাড় করেন। শুরু হয় দরিদ্র পরিবারের চিন সফরের প্রস্তুতি।
সপরিবার মেয়ে আসছে শুনে বাবা-মা বেজায় খুশি। মায়ের আবদার— অসম থেকে ফুলাম গামোসা, সরাই, অসমীয়া ঘটি-বাটি, তেজপাতা, মসুর ডাল, চিড়ে, সুজি যেন আনা হয়। বাবা বার বার খেতে চেয়েছেন বোঁদে-ভুজিয়া। চেয়েচিন্তে আবদারের সামগ্রী ঝুলিতে ভরে রওনা হন প্রমীলা।
গত মাসে কলকাতা থেকে হংকংগামী বিমানে ওঠেন প্রমীলাদেবী। সঙ্গে স্বামী, পুত্র, পুত্রবধু ও দুই নাতি। হংকং থেকে ফেরিতে চিনের সিনঝিনে যান ট্রেনে লাইবিন যেতে সময় লাগে ১৪ ঘণ্টা।
বাস, বিমান, জাহাজ আর দূরপাল্লার ট্রেনযাত্রার পরে অচিন প্রদেশে নিজের জন্মদাতার সামনে দাঁড়িয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন প্রমীলাদেবী। বাবা-মা এখনও ভাঙা অসমীয়া বলতে পারেন। কিন্তু রক্ত আর নাড়ির টানের সামনে তখন ভাষার প্রয়োজনই ফুরিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy