Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

দিল্লিতে আজ মোদী-অমিতেরই অগ্নিপরীক্ষা

প্রদীপের নীচেই অন্ধকার! দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এমনটাই মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। সত্তরটি আসনে ভোট হচ্ছে কাল। এটা যতটা না বিজেপির, তার চেয়েও বেশি যেন গুরু-শিষ্যের অগ্নিপরীক্ষা। গত লোকসভা ভোটের পরে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, এমনকী জম্মু-কাশ্মীরেও যে ভাবে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, তাতে মোদীর ‘মুখ’ আর অমিত শাহের সাংগঠনিক ও নির্বাচনী শৈলী সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে এক বিপুল প্রত্যাশা।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

প্রদীপের নীচেই অন্ধকার! দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এমনটাই মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। সত্তরটি আসনে ভোট হচ্ছে কাল। এটা যতটা না বিজেপির, তার চেয়েও বেশি যেন গুরু-শিষ্যের অগ্নিপরীক্ষা। গত লোকসভা ভোটের পরে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, এমনকী জম্মু-কাশ্মীরেও যে ভাবে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, তাতে মোদীর ‘মুখ’ আর অমিত শাহের সাংগঠনিক ও নির্বাচনী শৈলী সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে এক বিপুল প্রত্যাশা। প্রশ্ন উঠেছে, এই ভোটে কি মুখ থুবড়ে পড়বে সেই প্রত্যাশা? এবিপি-এসি নিয়েলসেন এবং আজ তকের সমীক্ষা অনুসারে বিজেপির চেয়ে আম আদমি পার্টি এগিয়ে আছে। দিল্লির বেশি মানুষ কিরণ বেদীর চেয়ে অরবিন্দ কেজরীবালকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন।

বিজেপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দিল্লি নিয়ে তাঁদের এখন উভয় সঙ্কট। কেজরীবাল যদি মুখ্যমন্ত্রী হন, তা হলে মোদী সরকারের সঙ্গে শুরু হবে তাঁর নিয়মিত সংঘাত। রাজ্যের দাবি নিয়ে নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লকের সামনে শুরু হবে বিক্ষোভ-ধর্না। আবার কিরণ বেদী যদি মুখ্যমন্ত্রী হন, তা হলেও যে মোদী খুব স্বস্তিতে থাকবেন, এমনটা মনে করেন না মন্ত্রিসভার অনেক রথী-মহারথীও। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মন্তব্য, কিরণ বেদী আদতে কঠোর পুলিশ অফিসার। কিন্তু খুবই আত্মকেন্দ্রিক চরিত্র। তাই অণ্ণা হজারে, কেজরীবাল তাঁর হাত থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিলেন, সেই কারণেই আমাদের জীবনও বিভীষিকা করে তুলতে পারেন এই ‘ক্রেন-বেদী’। বস্তুত, এই কারণেই অতীতে কিরণ বেদীর বিজেপিতে যোগ দেওয়া আটকে রেখেছিলেন দলের শীর্ষ নেতারা। রাজ্যের দাবি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে কেজরীবালের মতো তিনিও তৎপর হয়ে উঠতে পারেন নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে। কেজরীবাল না হয় অন্য দলের নেতা, নিজের দলের মধ্য থেকে এই বিপত্তি সামলাতে হিমশিম খেতে হতে পারে মোদী ও অমিত শাহকে।

এই পরিস্থিতির জন্মদাতা আসলে দিল্লি বিজেপির অভ্যন্তরীণ কলহ ও রাজ্য নেতাদের লাগামহীন ইগো-সর্বস্বতা। বৈশ্য নেতা বিজয় গোয়ল, ব্রাহ্মণ নেতা সতীশ উপাধ্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হর্ষ বর্ধন সকলেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। নিজেরা একমত হতে না পারায় অমিত শাহকে বাধ্য হয়েই কিরণ বেদীর মতো প্রার্থী ঠিক করতে হয়েছিল। এতে এক ঢিলে দু’টি পাখি মারতে চেয়েছিলেন অমিত শাহ। এক দিকে কেজরীবালের বেলুন কিরণ বেদীকে দিয়ে যথাসম্ভব ফুটো করে দেওয়া, আর অন্য দিকে নাগরিক সমাজের এক প্রতিনিধিকে বাইরে থেকে নিয়ে এসে বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দেওয়া। যদিও কিরণ বেদীর নাম ঘোষণার পরে দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভ-ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু মোদী-অমিত কঠোর নেতৃত্বের দাপটে বড় একটা ট্যা-ফুঁ করেননি এই নেতারা। কিরণ বেদীর নাম চূড়ান্ত করার আগে আরএসএসের মোহন ভাগবত ও বর্ষীয়াণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গেও কথা বলে তাঁদের সম্মতি নিয়ে নিয়েছিলেন অমিত শাহ। যাতে বিক্ষুব্ধ নেতারা তাঁদের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ না পান।

চিত্রনাট্য ঠিকই ছিল এই পর্যন্ত। কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল, দিল্লির মানুষ অনেকটাই কেজরীবালের পক্ষে। ন’মাসের মোদী সরকারের সম্পর্কে মোহভঙ্গের প্রচার চালিয়েও কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই রাজনৈতিক পরিসরটি দখল করতে পারেনি। শীলা দীক্ষিতের ভাবমূর্তি এক সময় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উজ্জ্বল ছিল। কিন্তু রাজ্যে তাঁর দলের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা এতটাই তীব্র ছিল যে তার রেশ এখনও কাটেনি। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অজয় মাকেনই যে সেরা ঘোড়া, সেটি মনে করেন অনেকেই। কিন্তু মানুষের বীতরাগ মুছে মোদী-অমিত শাহের বিকল্প হয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না কংগ্রেসের পক্ষে।

দলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী কিরণ বেদীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা
অরুণ জেটলি। নয়াদিল্লির সাংবাদিক বৈঠকে শুক্রবার। ছবি: পিটিআই।

কেজরীবাল এর আগের বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েও সরকার ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এ বার তাঁর প্রচারের মূল বক্তব্য ছিল, আপনারা যথেষ্ট সংখ্যা দিলে আমি স্থায়ী সরকার গঠন করে আপনাদের সমস্যা সমাধান করব। অসমাপ্ত কর্মসূচি যাতে রূপায়ণ করতে পারেন, তার জন্য একটি অভিনব প্রচার অভিযান চালিয়েছেন কেজরীবাল। এই প্রচারের জন্য যে পয়সার কোনও ঘাটতি কেজরীবালের নেই, সেটিও কিন্তু বিজেপি নেতারা টের পেয়েছেন। কেজরীবালের মুখপাত্ররা বলছেন, তাঁদের দল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। সেটাই তাঁদের রাজনৈতিক শক্তি। অমিত শাহ নিজেও দলের ঘরোয়া বৈঠকে স্বীকার করেছেন, দিল্লির মানুষের মধ্যে নানা স্তর আছে। অভিজাত সম্প্রদায় যেমন আছে, ঠিক তেমন আছে নিম্নবর্গ। আছেন সরকারি চাকরিজীবী ও আমলারা। সরকারি কর্মীদের নিয়মানুবর্তিতা ও কর্মসংস্কৃতি নিয়ে মোদীর কঠোরতায় নাকি অনেকেই ক্ষুব্ধ। দিল্লিবাসীর এই অংশটি নাকি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে তৎপর। আবার নিম্নবর্গ এই ‘মাফলারওয়ালা’-কে তাঁদের দুঃখ-বেদনার পরিত্রাতা বলে মনে করছেন। সিপিএম যেমন বলছে, এক সময় দিল্লিতে অরুণা আসফ আলি পুরসভা গঠন করে এই পরিসরেরই নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ বামপন্থীদের ব্যর্থতায় কেজরীবাল এই পরিসরের দখল নিতে পেরেছেন। শেষ পর্যন্ত ভোটের ফল কী হবে, সেটা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সব পক্ষই মনে করছেন, সরকার গঠনের সম্ভাবনার সুতো ঝুলছে মাত্র ৪-৫টি আসনের ব্যবধানে। নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তাঁর রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের নির্বাচনে কংগ্রেস হেরেছে। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস একের পর এক রাজ্য দখল করেছে। আবার কংগ্রেস জমানায় বিজেপি দখল করেছে বহু রাজ্য। ভারতের মতো বিশাল যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে কেন্দ্র ও রাজ্যের এই ভিন্ন রাজনীতির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ই শীলা দীক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন দিল্লির। তফাত একটাই। এ বার প্রতিপক্ষ কংগ্রেস নয়। কংগ্রেস এবং বিজেপি এই প্রধান দুই সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের মেরুকরণের বাইরে খোদ রাজধানী শহরেই উত্থান হয়েছে কেজরীবাল নামে একটি নতুন শক্তির।

প্রশ্ন হল, ভোটের ফল যা-ই হোক, এই উত্থান কি বিজেপি-বিরোধী এক নতুন রাজনীতির মঞ্চ তৈরি করতে পারে? পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আক্রমণাত্মক রাজনীতিতেও কি এর কোনও প্রভাব পড়তে পারে?

অন্য বিষয়গুলি:

delhi election jayanta ghoshal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE