রক্তের দাগ: এখানেই গুলি করা হয় শ্রমিকদের। কাতরাসুতে। এপি
প্রশ্নের পর প্রশ্ন। এখানে ঢুকে পড়লেন কী করে? একদম ‘সেফ’ এলাকা নয়, জানেন না? এ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? সন্ত্রাসবাদীরা এখানেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। যে কোনও সময় ‘ফায়ারিং’ শুরু হতে পারে, কেন বুঝতে পারছেন না?
সোপিয়ান থেকে কুলগামে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে গাড়ির চালক গ্রামের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা ধরেছিলেন। দু’দিকে শুধু আপেল বাগান। গাছ থেকে আপেল পেড়ে বাক্সে পোরা হচ্ছে। বেলা সাড়ে ১২টা। হঠাৎ কখন রাস্তা সুনসান হয়ে গিয়েছে, খেয়ালই করিনি।
কাতরাসু গ্রামের তিন মাথার মোড়ে রাস্তা আটকাল জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের কম্যান্ডো বাহিনী। চারদিকে শুধু বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হাতে ধরা একে-৪৭, লাইট মেশিনগান। বুলেটপ্রুফ গাড়ির মাথায় কঠিন-চোয়াল জওয়ানদের হাতে স্নাইপার। নেতৃত্বে রয়েছেন কুলগামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, দুই ডিএসপি। সাংবাদিকের পরিচয়পত্র দেখিয়েও ছাড় মিলল না। নাম-ধাম জেনে নিয়ে পুলিশ-কর্তারা কাকে কাকে ফোন করে সব কিছু জানালেন। তার পরে নির্দেশ এল, ‘‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে যান। নেহাত দিল্লি থেকে এত দূর চলে এসেছেন...।’’ তাই এইটুকু ‘সৌজন্য’। তত ক্ষণে মোবাইলে বেশ কিছু ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে। অ্যালবাম খুলে দেখাতে হল।
দু’একটি বাদে অধিকাংশ ছবিই ডিলিট করতে হল।
কাতরাসু-র এই তিন রাস্তার মোড়েই মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ সশস্ত্র জঙ্গিরা উদয় হয়। গ্রামের মসজিদ থেকে তখন আজানের সুর ভেসে আসছিল। মোড়ের মাথাতেই একটা সাদামাটা দোতলা বাড়ি। একতলায় বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের দোকান। গ্রামের একজন বাড়ির দোতলার দিকে আঙুল দেখালেন। ওখানেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছিলেন মুর্শিদাবাদ থেকে কুলগামে কাজ করতে আসা বাঙালি শ্রমিকরা। তখনই জঙ্গিরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ছয় জনকে। ঘরে পড়ে থাকে ব্যাগ, জামাকাপড়, রান্নার শাকসবজি। কিছু দূরে নিয়ে গিয়ে গলির মধ্যে ঢোকানো হয় ছ’জনকে। একটি বাড়ির দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালায় জঙ্গিরা। দলের একজন সে সময় বাইরে বেরিয়েছিলেন বলে রক্ষা পেয়ে যান। বুধবার দুপুরে দেখা গেল, দেওয়ালে পরপর গুলির দাগ। এক কোণায় নিহতদের রক্তমাখা হাওয়াই চটি। জলে ধুয়ে দেওয়ার পরেও রাস্তায় রক্তের দাগ যায়নি।
পুলিশের সন্দেহ, জইশ-ই-মহম্মদ এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। দলে এক জন পাকিস্তানি জঙ্গি থাকাও আশ্চর্যের নয়। কিন্তু বাকিরা সবাই স্থানীয় জঙ্গি বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশ-কর্তাদের মতে, সে কারণেই মঙ্গলবার রাত থেকে গোটা কাতরাসুতে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও একজন জঙ্গিরও টিকির দেখা মেলেনি। বুধবার সকাল থেকে কুলগামের এএসপি-র নেতৃত্বে ফের ‘অপারেশন’ শুরু হয়েছে। জাতীয় সড়ক থেকে কুলগামে বাইরের গাড়ির প্রবেশ নিষেধ। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে চিরুনি তল্লাশি চলছে। প্রায় সবাই ঘরবন্দি। বেলা সাড়ে ১২টাতেই মধ্যরাতের নীরবতা। জঙ্গিরা যাতে বাইরে বার হতে না পারে, সে জন্যই কাতরাসু-র তিন রাস্তার মোড়ে বিশাল বাহিনীর প্রহরা।
এই ‘যুদ্ধক্ষেত্র’র মধ্যেই একটি বাড়ির বারান্দায় মুখ ভার করে বসে গ্রামের সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধরা। যেন গ্রামেরই কারও মৃত্যুতে শোকসভা চলছে। বাঙালি সাংবাদিক বলে পরিচয় দিতে বয়স্ক মানুষগুলো যেন লজ্জায় মিশে গেলেন— “আপনার রাজ্যের লোকেরা আমাদের মেহমান ছিলেন। এখানে তো অনেক রাজ্যের লোক কাজ করতে আসে। রাজমিস্ত্রি, আপেল বাগানের কাজ। কারও
গায়ে কোনও দিন হাত ওঠেনি। আমাদের কাশ্মীরিয়ত-এ রক্তের দাগ লেগে গেল।”
দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা, কুলগাম, অনন্তনাগ, সোপিয়ান বরাবরই জঙ্গিদের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত। ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ হওয়ার পর থেকে দক্ষিণ কাশ্মীর যেন আরও ফুঁসতে শুরু করেছে। সোপিয়ানে আপেল নিতে আসা ভিন রাজ্যের ট্রাকচালকদের নিশানা করা শুরু হয়েছে। চার জন ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন। মঙ্গলবার মুর্শিদাবাদের শ্রমিকদের উপর হামলা তাতে নতুন মাত্রা যোগ করল। কিন্তু ভিন রাজ্যের মানুষের উপরে এই আক্রমণকে ‘কাশ্মীরিয়ত’ বা কাশ্মীরের মনন, সংস্কৃতি, মেহমান নওয়াজির উপর আঘাত হিসেবেই দেখছেন প্রবীণ কাশ্মীরিরা। তাঁদের স্পষ্ট কথা, “আমরা এ সব চাই না। সবাই তো এখানে রুটিরুজির জন্য আসছেন। এমনও নয় বাইরের রাজ্যের শ্রমিকরা এসে কাশ্মীরি যুবকদের কাজে ভাগ বসাচ্ছেন। তা হলে ওদের উপর হামলা হবে কেন?”
বৃহস্পতিবারই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি দুই উপরাজ্যপালকে শপথ নেওয়াবেন। তার ৪৮ ঘণ্টা আগে ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের উপরে জঙ্গি হামলা দেখে পুলিশ-কর্তাদের ধারণা, জঙ্গিরা এ বার এসপার-ওসপার চাইছে। জওয়ানদের নিশানা করা মুশকিল। তাই ভিন রাজ্যের নিরীহ শ্রমিকদের নিশানা করা হচ্ছে। কানের কাছে মুখ এনে কাতরাসুর এক বৃদ্ধ মনে করালেন, “একতরফা ৩৭০ রদ করার সময় তো ওরা কাশ্মীরিয়তের কথা ভাবেনি। সন্ত্রাসবাদীরাও আর কাশ্মীরিয়তের কথা ভাববে কেন?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy