Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

প্রথম বার্তা, অহঙ্কার এলে জুটবে একই শিক্ষা

সুনামি তোলার পরেই আবেগে রাশ! শান্ত, সংযত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি। তবু কোথায় যেন একটা ভয়! প্রথম ইনিংস যদি যৌবনের উদ্দাম বহিঃপ্রকাশ হয়, দ্বিতীয় পর্বের আবির্ভাবে ঢের বেশি পরিণত তিনি! দেড় বছর আগেও এক বার মুখ্যমন্ত্রিত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

সুনামি তোলার পরেই আবেগে রাশ! শান্ত, সংযত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি। তবু কোথায় যেন একটা ভয়!

প্রথম ইনিংস যদি যৌবনের উদ্দাম বহিঃপ্রকাশ হয়, দ্বিতীয় পর্বের আবির্ভাবে ঢের বেশি পরিণত তিনি!

দেড় বছর আগেও এক বার মুখ্যমন্ত্রিত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। তখন ক্ষমতায় বসেই এক ঝটকায় সমাজ পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন রাজস্ব দফতরের প্রাক্তন এই আমলা। আর আজ বিজেপির দর্প চূর্ণ করে যখন নতুন অভিষেক ঘটছে, তখন তিনি কিন্তু বেশ ভীত। কিছুটা চিন্তিত। যে গুরুদায়িত্ব তাঁর উপর এসে পড়েছে, তা পালনে তিনি সক্ষম হবেন কিনা, সেই আশঙ্কাও এখন তাঁর মনের কোণে। দল বলছে, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অতীত রাস্তা থেকে সরে এসে আপ শীর্ষনেতা এখন সকলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলার বার্তা দেওয়ার পক্ষে। ক্ষমতা নয়, মানুষের এত আস্থা ও বিপুল প্রত্যাশার প্রকাশই পাল্টে দিয়েছে কেজরীবালকে।

অথচ, দৃশ্যপট কিন্তু অনেকটাই এক। দেড় বছর আগে ঠিক এ ভাবেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অভিবাদন কুড়িয়েছিলেন কেজরীবাল। সে দিন ভোটের ফল যত এগিয়েছিল ঘণ্টায় ঘণ্টায় তা মাইকে এসে সমর্থকদের জানিয়ে গিয়েছিলেন। আজও বারান্দায় এলেন তিনি। ঠিক সে ভাবেই, ফুলহাতা সোয়েটার পরে। কিন্তু এক বারই। দলীয় কর্মী, দিল্লিবাসী ও পরিবারকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিলিয়ে গেলেন দফতরের অন্দরে। আর দেখা যায়নি তাঁকে। এক বার মাত্র বাইরে এসে যা বললেন, তাতেও উঠে এল ভয়ের প্রসঙ্গ। তুমুল জয়ের দিনেও তাঁর প্রথম বার্তাটি স্রেফ হুঁশিয়ারি। “কংগ্রেস ও বিজেপি হেরেছে অহঙ্কারের কারণে। একই মনোভাব নিলে, পাঁচ বছর পরে মানুষ আমাদেরও একই শিক্ষা দেবেন। তাই অহঙ্কার নয়। হাতজোড় করে সেবা করতে হবে মানুষের।” আপাত ভাবে নীতিবাক্যের মতো শোনালেও কেজরীবাল জানেন, একা কিছু করতে পারবেন না। করতে হবে সকলকে নিয়েই। সাফল্য মাথায় চড়লে যা সম্ভব নয়।

দফতরে ঢুকে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীকে ছোট্ট খোঁচা দিতে ছাড়েননি কেজরীবাল। লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী প্রথম বার যশোদাবেনকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিলেও আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পা পড়েনি তাঁর। আর সেখানে আজ জনতার সামনে এনে স্ত্রী সুনীতার পরিচয় করিয়ে দিয়ে কেজরীবাল বলেন, “আমার স্ত্রী কখনওই সামনে আসতে চান না। আমিই আজ জোর করে নিয়ে এসেছি। আমার সমস্ত লড়াইয়ের অন্যতম প্রেরণা হল সুনীতা।” একে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে হাল্কা কটাক্ষ বলেই মনে করছে আপ শিবির। তার পরেই অবশ্য ঢুকে পড়েন সংযমের খোলসে। সমর্থক ও বিধায়কদের বিপুল গরিষ্ঠতার গুরুদায়িত্ব ও আগামী ৫ বছর নীরবে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে কার্যালয়ের ভিতরে সেঁধিয়ে যান তিনি।

কেজরীবালের সৎ ভাবমূর্তি, বিদ্যুতের বাড়তি বিল, জন-লোকপাল প্রশ্নে তাঁর আপসহীন লড়াই আগেই মানষের মনে ছাপ ফেলেছিল। গত বিধানসভা ভোটের আগে দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, নিরাপত্তার অভাব— নানা কারণেই তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি মানুষের যে ক্ষোভ জমেছিল, তা উগরে দেওয়ার মঞ্চ হয়ে ওঠে আপ। কিন্তু ক্ষমতায় এসে হঠকারী সিদ্ধান্তে সেই জমি হারিয়ে ফেলেন কেজরীবাল। এ বার তিনি সেই জমি ফেরত পেতে চলেছেন, ভোটের পর থেকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল বুথ-ফেরত সমীক্ষাগুলি।

তাই আজ সকাল থেকেই কাঙ্ক্ষিত জয়ের গন্ধে পূর্ব-পটেলনগরে আপ দফতরের সামনে সমর্থকদের ভিড় জমতে শুরু করে। আটটার মধ্যে কার্যালয়ে চলে আসেন কেজরীবাল। নিজে সামনে আসেননি। তবে দফতরের কার্যালয়ের টিভিতেই দেখেছেন কী ভাবে দল এগিয়ে যাচ্ছে নিশানায়। সংখ্যা ছাপিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্য। সাধারণ কর্মীদের জন্য বসানো হয়েছিল একাধিক জায়ান্ট স্ক্রিন।

কার্যত বিরোধীশূন্য দিল্লি বিধানসভা। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ জুটির অশ্বমেধের ঘোড়া রুখে দিয়ে প্রাণসঞ্চার করেছেন জাতীয় রাজনীতির বিরোধী শিবিরে। এমন দিনেও কেজরীবাল কেন আগাগোড়াই এত সংযমী? ঘনিষ্ঠরা বলছেন, অতীত অভিজ্ঞতা অবশ্যই প্রথম কারণ। এ বার নিজেকে প্রমাণ করার দায়িত্বও এসে পড়েছে ঘাড়ে। যে কারণে, প্রথম দফায় ৪৯ দিনের মাথায় সরকার ফেলে দেওয়ার ভুল স্বীকার করে ভোটের মাস ছয়েক আগেই দলীয় কর্মীদের সঙ্গে বসে তৈরি করেছেন বিজেপিকে হারানোর নীল-নকশা।

কী সেই রণকৌশল?

কেজরীবাল প্রথমেই জোর দেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত জনসংযোগের উপর। নিঃশব্দে প্রচার শুরু করেন বিভিন্ন মহল্লায়। লোকসভা নির্বাচনে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সমর্থন টেনে নিয়েছিলেন মোদী। তাই প্রচারের শুরুতে কেজরীবাল মূলত বেছে নেন গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্তদের। আপ নেতা দিলীপ পাণ্ডের ব্যাখ্যা, “দলীয় কর্মী ও কেজরীবাল নিজে পড়ে থেকেছেন ওই মহল্লাগুলিতে। দিনের পর দিন বুঝিয়েছেন, কেন আপের ক্ষমতায় আসা উচিত। মানুষ প্রশ্ন তুলেছে। সমালোচনা করেছে। কিন্তু দলীয় কর্মীরা পিছিয়ে আসেননি। ভোটে সেই দীর্ঘ প্রচারের সুফল মিলেছে।”
৪৯ দিনের মাথায় সরকার থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা অকপটে সর্বত্র স্বীকার করে নিয়েছেন কেজরীবাল। মানুষের কাছে ভুল স্বীকার ভাল ছাপ ফেলেছে মানুষের মনে। বাড়িয়েছে কেজরীবালের বিশ্বাসযোগ্যতা।

বিজেপি নেতারা যখন কেজরীবালের বিরুদ্ধে কুৎসায় নেমেছেন, তখন বিরোধী শিবিরের উদ্দেশে এক বারের জন্যেও ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে হাঁটেননি কেজরীবাল। উল্টে মানুষকে বুঝিয়েছেন, মোদী দেশের জন্য ভাল হতে পারেন। কিন্তু তিনি দিল্লি শাসন করবেন না। মানুষকে তিনি বোঝান, দিল্লি শাসন করার প্রশ্নে কেন তিনি উপযুক্ত। কী তাঁর স্বপ্ন, তা-ও ফেরি করেছেন তিনি। নেতিবাচক পথের পরিবর্তে আপের এই ইতিবাচক প্রচারে সাড়া দিয়েছেন মানুষ।

কেজরীবালের মাফলার পরা আম-আদমি ভাবমূর্তি। যার কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছে মোদীর দশলাখি স্যুট।

বিজেপির মেরুকরণের উল্টো পথে হেঁটে সকলকে নিয়ে চলার বার্তা। যে কারণে দিল্লির মুসলিম সমাজ কংগ্রেসের বদলে পাশে দাঁড়িয়েছে কেজরীবালের।

প্রতিপক্ষ হিসেবে কিরণ বেদীর উপস্থিতিও কেজরীবালের পক্ষে গিয়েছে বলে মনে করছে আপ শিবির। হঠাৎ কেজরীবালের প্রাক্তন সহযোগী বেদীর বিজেপিতে যোগদান ভাল ভাবে নেননি সাধারণ মানুষ।

সব মিলিয়ে আগেকার ‘মিসঅ্যাডভেঞ্চারিজম’-এর ভুলগুলি শুধরেই ফের ক্ষমতায় কেজরীবাল। দল বলছে, এ কারণে তিনি শুরু থেকেই সাবধানী। মেপে পা ফেলতে চান। আজ সন্ধেতেই বিধায়ক দলের বৈঠকে পরিষদীয় নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে কেজরীবালকে। রাতে তিনি দেখা করেন উপরাজ্যপাল নাজিব জঙ্গের সঙ্গেও। সরকার গড়ার দাবিও পেশ করেন। দলীয় সূত্রে ঠিক হয়েছে, আগের বারের মতোই রামলীলা ময়দানে শপথ নেবেন তিনি। দিন ঠিক হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইনস ডে। ভালবাসার দিন। দিল্লিবাসীর উদ্দেশে আজ থেকেই এফএম-এ প্রচারের নয়া পর্ব শুরু করে দিয়েছেন কেজরীবাল। প্রত্যেক দিল্লিবাসীর উদ্দেশে বলছেন, “যাঁরা চেষ্টা করেন তাঁদের হারতে হয় না। রামলীলা ময়দানে আমি একা নই, আপনারাও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। আপনারা আসবেন তো?” যা শুনে রাতে চিত্তরঞ্জন পার্কে এক প্রবীণের মুখে উঠে এল চেনা গানের আধকলি, আমরা সবাই রাজা...

এ প্রশ্ন না বিস্ময়, স্পষ্ট হল না।

অন্য বিষয়গুলি:

delhi assembly election aap kejriwal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE