Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘দেশদ্রোহী তকমাও পেয়েছি, আজ লড়াই সার্থক’

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে কাঠুয়ায় ঘটনাটি ঘটে। কাঠুয়ার ওই বাচ্চা মেয়েটিকে যে ভাবে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল, সেটা শোনার পরে চুপ করে বসে থাকতে পারিনি।

দীপিকা সিংহ রাজাওয়াত (কাঠুয়া মামলার আইনজীবী)
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৯ ০২:১৩
Share: Save:

মানুষ মামলা লড়ার জন্য সাহায্য চেয়ে আইনজীবীর কাছে যান। এ ক্ষেত্রে নিজের পেশাদার ‘ইগো’ ঝেড়ে ফেলে আইনজীবী হয়ে আমিই ছুটে গিয়েছিলাম মামলাটির বিষয়ে খোঁজ নিতে। তার ফল পেলাম সোমবার।

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে কাঠুয়ায় ঘটনাটি ঘটে। কাঠুয়ার ওই বাচ্চা মেয়েটিকে যে ভাবে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল, সেটা শোনার পরে চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। নিজেকে বলি, ওই ছোট্ট মেয়েটা যদি সুবিচার না পায়, তা হলে এগারো বছর ধরে এই পেশায় থেকে কী করলাম! অপরাধীরা শাস্তি পাওয়ায় মনে হচ্ছে, এত দিনের উৎকণ্ঠার অবসান হল।

কাঠুয়া গণধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত আট জনের মধ্যে ছ’জনকেই দোষী সাব্যস্ত করেছে পঠানকোট বিশেষ আদালত। আইনি লড়াইয়ে এটা খুবই বড় একটা জয়! বাকি দুই অভিযুক্তের এক জন বেকসুর খালাস পেলেও নাবালক অভিযুক্তের মামলার শুনানি এখনও জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টে চলছে।

মামলা হাতে নিয়েই বুঝতে পারি, এই এলাকা থেকে নিরপেক্ষ ভাবে মামলা লড়া সম্ভব নয়। অসম্ভব চাপ আসতে থাকে হতদরিদ্র পরিবারটির উপরে। রাজনৈতিক চাপ তো ছিলই, একই সঙ্গে প্রভাবশালীদের চাপে প্রাথমিক ভাবে বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়ে যায়। তখনই আমরা হাইকোর্টে মামলা অন্যত্র স্থানান্তরের আবেদন জানাই। মামলা পঠানকোটে সরানো হয়। নতুন করে কার্যবিধি শুরু হয়। পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের হাতে তদন্তভার আসে। সর্বোচ্চ আদালতের বিশেষ ভাবে নির্দেশ ছিল, এই মামলার শুনানির দিন ‘মিস’ করা যাবে না।

পাশাপাশি জঘন্য ওই অপরাধকে ধর্মের তাস বানিয়ে খেলা চলতে থাকে। রাজনৈতিক প্রভাব, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে খেপিয়ে তোলার মতো উস্কানি ছিল। মামলা হাতে নিয়ে আমাকেও হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দিনের পর দিন ট্রোল করা হয়েছে। এমনকি, বাচ্চা মেয়েটির জন্য আইনি লড়াইয়ে অংশ নিয়ে এমনও শুনতে হয়েছে— আমি নাকি দেশদ্রোহী! চুপ করে থেকেছি। আত্মবিশ্বাসী হয়ে ধৈর্য ধরে থেকেছি। ভরসা রেখেছি নিজের উপর। সেই সব অপমানের জবাব এ দিনের আদালতের রায়।

তবে আমার একার লড়াইয়ে এই রায় নয়। ক্রাইম ব্রাঞ্চের যে অভিজ্ঞ অফিসারেরা কাঠুয়া মামলার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছেন, আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে তদন্ত করেছেন, অসম্ভব পরিশ্রম করে গিয়েছেন দিনের পর দিন, তাঁদের কথাও বলব। সরকারের পক্ষে যে আইনজীবীরা লড়েছেন, তাঁদের অবদানও কম নয়।

সর্বোপরি, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা। যার উপরে আমার সব সময়ে আস্থা ছিল। লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পরে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, হয়তো অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে। অভিযুক্তদের সমর্থনে যেখানে রাজনৈতিক দল মিছিল বার করে, সেখানে এই আশঙ্কা অমূলক নয়। তবে সোমবারের রায় প্রমাণ করে দিল, আইন কারও জন্য আলাদা নয়। কাঠুয়া-কাণ্ডে তিন জনের যাবজ্জীবন হয়তো মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেবে না, তবে ওর বাবা-মা জানবেন বিচার হয়েছে। সমাজ জানবে, এমন ভয়ানক অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না।

অনেকে বলেছেন, আমি নাকি প্রচারের জন্য মামলা হাতে নিয়েছিলাম। তাঁদের বলব, আমি যখন ব্যক্তিগত ভাবে মামলা হাতে নিই, তখনও অনেকে ঘটনাটা জানতেনই না। এক সময়ে বলা হচ্ছিল, আমি মামলা থেকে সরে গিয়েছি। বস্তুত সেটা সম্ভব ছিল না। নিম্ন আদালত থেকে এই মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছি। শেষ দিকে সরকারি আইনজীবীরাই শুনানি করেছেন। বেসরকারি আইনজীবী হিসেবে সে এক্তিয়ার আমার ছিল না। তাই মামলার গতিবিধির উপরে নজর রেখে গিয়েছি। কিন্তু নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের বিরোধিতা উড়িয়ে যে মামলা লড়তে এসেছিলাম, তা কি মাঝপথে ছেড়ে যাব বলে? আজ সেই লড়াই সার্থক।

(অনুলিখন: চৈতালি বিশ্বাস)

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Kathua Rape Case Kathua Rape কাঠুয়া
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE