ভারতীয় কম্যান্ডোরা সে দিন এক ধরনের মার্শাল আর্ট প্রয়োগ করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। —ফাইল চিত্র।
ঘাতক রাতটা অনেকখানি বদলে দিয়েছে পরিস্থিতি। লাদাখে এলএসি (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা) বরাবর ক্রমশ বাড়ছে উত্তাপ।বাহিনী, সাঁজোয়াগাড়ি, কামান, ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ, ক্ষেপণাস্ত্র, হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমান, সরঞ্জাম, রসদ দ্রুত বাড়ছে সীমান্তের দু’পাশে। কিন্তু নিরস্ত্র লড়াইয়ের জন্যও প্রস্তুতি বাড়াচ্ছে চিন। সীমান্তে বেজিং এ বার মার্শাল আর্ট বিশেষজ্ঞদের পাঠাচ্ছে বলে খবর এসেছে রবিবারই। কিন্তু এই বিপুল সমরসজ্জার মাঝে হঠাৎ মার্শাল আর্টের প্রয়োজন কেন অনুভূত হচ্ছে লালফৌজের অন্দরে? নয়াদিল্লি সূত্রের খবর, রহস্যটা লুকিয়ে রয়েছে ১৫ জুনের ঘাতক রাতের ঘটনাপ্রবাহেই।
৬ জুন কোর কম্যান্ডার স্তরের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এলএসি সংলগ্ন এলাকা থেকে বাহিনী কয়েক কিলোমিটার করে পিছিয়ে নেবে দু’দেশই। কিন্তু চিন কথা রাখেনি। সেনা সূত্রের খবর, প্রোটেক্টিভ পেট্রল-১৪ (পিপি-১৪)-এর পশ্চিম ঢালের নীচে যে অস্থায়ী শিবির তৈরি করে ফেলেছিল চিন, বৈঠকে হওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তা সরিয়ে নেওয়ার কথা ছিল। সরানো হয়েছে কি না, তা দেখতে ১৩ অথবা ১৪ জুন ছোট একটি টহলদার দল পাঠায় ভারতীয় সেনা। গালওয়ান ও শিয়োক নদীর সঙ্গমস্থলের পূর্ব তীরে ভারতীয় বাহিনীর যে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার, সেখান থেকেই পাঠানো হয়েছিল এই দল। দুই নদীর প্রশস্ত সঙ্গমস্থল পেরিয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে পিপি-১৪। সেই শিখরের পিছনেই চিনা শিবির মাথা তুলেছিল অলক্ষ্যে। অতএব ভারতীয় টহলদার দলকে সেখানেই যেতে হয়। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা যায়, শিবির চিন সরায়নি। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মেনে চিনা বাহিনীকে সরে যেতে হবে, সে দিন জানায় ভারতীয় টহলদার দলটি। চিনা বাহিনী সে দিনের তাঁবু গোটানোর কাজ শুরু করে। ভারতী টহলদার দল ফিরে আসে।
পিপি-১৪-র অবস্থা দেখতে ১৫ জুন ফের টহলদার দল পাঠানো হয়েছিল। ১০ জনের সেই দলও ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখে, চিনা তাঁবু সরেনি। সে দিন বচসা শুরু হয় দুই বাহিনীর মধ্যে। চিনা সেনা সরতে রাজি না হওয়ায় ভারতীয় টহলদাররা তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দেন। কিন্তু আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে চিন যে বড় বাহিনী তৈরি রেখেছিল সেখানে, তা ভারতীয় টহলদাররা প্রথমে বুঝতে পারেননি। সব দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয় জনা দশেকের ভারতীয় দলটিকে। আটক করা হয় তাঁদের।
সে রাতে ভারতীয় কম্যান্ডো বাহিনীর প্রত্যাঘাতের জুৎসই জবাব খুঁজছে চিন। —প্রতীকী চিত্র।
আরও পড়ুন: তিব্বত হতে রাজি নই! কেন্দ্রশাসিত হওয়ার ‘অপমান’ সয়েও বলছে লাদাখ
এই ঘটনার খবর পেয়েই ১৬ বিহার রেজিমেন্টের কম্যান্ডিং অফিসার কর্নেল সন্তোষ বাবু ৩০ জনের বাহিনী সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেন। চিনা শিবির পাহাড়ের ঢালের পিছনে হলেও পিপি-১৪-র শিখরে তখন মোতায়েন রয়েছেন চিনা টহলদাররা। খাড়াই বেয়ে পিপি-১৪-এর দিকে ভারতীয় বাহিনীকে উঠতে দেখে তারা হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেন। আলোচনা করতে চাইলে যে কোনও এক জন আসুন— এমনই বার্তা দেওয়া হয় চিনের তরফে। কর্নেল সন্তোষ বাবু সে শর্ত মেনে নিয়ে নিজের বাহিনীকে দাঁড় করিয়ে রেখে দু’জন সঙ্গীকে নিয়ে পিপি-১৪-য় যান। কিন্তু আলোচনা অসফল হয়নি বলেই সেনা সূত্রের খবর। যে ১০ ভারতীয় টহলদারকে আটকে রেখেছিল চিনা বাহিনী, তাঁদেরও ছাড়েনি চিন। ফলে কর্নেল ও তাঁর দুই সঙ্গী ফেরার পথ ধরেন। সে সময় পিছন থেকে তাঁদের উপরে হামলা হয় এবং খুকরির আঘাতে কর্নেল ও তাঁর দুই সঙ্গীকে খুন করা হয় বলে সেনার একাংশের দাবি।
কম্যান্ডিং অফিসারকে খুন হয়ে যেতে দেখে নীচে অপেক্ষমান বাহিনী দ্রুত রেডিয়ো বার্তা পাঠায় ব্যাটালিয়ন সদরে। ব্যাটালিয়ন সদর থেকে তখনই ৩০ জনের কম্যান্ডো টিম পাঠিয়ে দেওয়া হয় পিপি-১৪-র উদ্দেশে। পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে ব্যাটালিয়নগুলো রয়েছে, খবর যায় সেগুলোর কাছেও। তারাও বাহিনী পাঠায় পিপি-১৪-র দিকে। কিন্তু কম্যান্ডিং অফিসারকে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছিলেন যে ২৭ জওয়ান, তাঁরা আর অপেক্ষা করেননি। সীমিত লোকবল নিয়েই তাঁরা উপরে ওঠেন এবং প্রত্যাঘাতের চেষ্টা করেন। শ’তিনেক চিনা জওয়ানের সঙ্গে লড়তে হয় তাঁদের। ফলে, ভারতের দিকে হতাহতের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।
ভারতীয় শিবির থেকে কম্যান্ডো টিম এবং অন্যান্য ব্যাটেলিয়নের পাঠানো বাহিনী পিপি-১৪-য় পৌঁছনোর পরে কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল বলে নয়াদিল্লি সূত্রে জানা যাচ্ছে। সে লড়াইতেও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়নি। কিন্তু কম্যান্ডো বাহিনীর সাঙ্ঘাতিক প্রত্যাঘাতে চিনা ফৌজ পর্যুদস্ত হয় বলে সেনা সূত্রের দাবি। ভারত বড়সড় বাহিনী পাঠিয়েছে দেখে চিনা ফৌজ পিছু হঠতে শুরু করে বলেও সেই সূত্র জানাচ্ছে। রাস্তা ও পরিকাঠামো তৈরির জন্য যে আর্থমুভার সেখানে নিয়ে গিয়েছিল চিনা ফৌজ, সেটিকে দ্রুত সরানোর চেষ্টা হতেই পাহাড়ে ধস নামে সে রাতে। সেই ধসেও চিনা বাহিনীকে বড়সড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয় বলে শোনা যাচ্ছে। হতাহতের সংখ্যা সব মিলিয়ে ঠিক কত, তা নিয়ে চিন কোনও মন্তব্য করেনি। ভারত দাবি করেছিল, সংখ্যাটা অন্তত ৪৩। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছিলেন, চিনের তরফে অন্তত ৩০-৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে ভারতীয় বাহিনীর একটি সূত্রের দাবি, প্রত্যাঘাতের ধাক্কা এবং ধসের কবলে পড়া মিলিয়ে চিনের তরফে হতাহতের সংখ্যাটা বেশ কয়েক গুণ।
হতাহতের সংখ্যা কত, তা প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে চিনে ক্ষোভ বাড়ছে নাগরিকদের মধ্যে, এমন খবর ইতিমধ্যেই এসেছে। কিন্তু চিনা বাহিনী সম্ভবত তা নিয়ে ভাবিত নয়। চিনা বাহিনী আরও বেশি ভাবিত সে রাতে ভারতীয় কম্যান্ডো বাহিনীর প্রত্যাঘাত নিয়ে। ভারতীয় সেনা প্রায় সব ব্যাটালিয়ন সদরেই জনা তিরিশের একটি কম্যান্ডো টিম রাখে। তার নাম ‘ঘাতক’। নিরস্ত্র অবস্থায় সেই ঘাতকরা যে বিক্রম দেখিয়েছেন ১৫ জুন রাতে, চিন এখন তারই জুৎসই জবাব খুঁজছে বলে খবর। সেই কারণেই লাল ফৌজে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া শুরু হয়েছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়।
আরও পড়ুন: সরেনি সেনা, গালওয়ানে কাল ফের ভারত-চিন কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠক
ভারতীয় কম্যান্ডোরা সে দিন এক ধরনের মার্শাল আর্টই প্রয়োগ করেছিলেন বলে খবর আসছে। নিরস্ত্র কম্যান্ডোদের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল ‘জাপানিজ স্ট্র্যাঙ্গল হোল্ড’— খবর সেনা সূত্রের। কী এই জাপানিজ স্ট্র্যাঙ্গল হোল্ড? প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ তথা প্রাক্তন সেনাকর্তারা বলছেন, নীরবে হানা দিয়ে নিঃশব্দে শত্রুকে খতম করার পদ্ধতি হল এই ‘দাঁও-প্যাঁচ’। অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা কর্নেল সৌমিত্র রায়ের কথায়, ‘‘কম্যান্ডো কোর্সের একদম শুরুতেই এই দাঁও-প্যাঁচ শেখানো হয়। এতে নিঃশব্দে পৌঁছে যেতে হয় শত্রুর কাছে। অতর্কিত পদাঘাতে তাকে ধরাশায়ী করতে হয়। তার পরে নিমেষে দু’হাতে তার মাথা, গলা ও ঘাড় পেঁচিয়ে নিতে হয়। একটা হাত দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হয় গলা তথা ঘাড়। অন্য হাত দিয়ে ধরতে হয় মাথা। তার পরে খুব জোরে মাথাটাকে বাইরের দিকে এবং গলাটাকে ভিতরের দিকে ঠেলতে হয়। এতে নিমেষে গর্দান ভেঙে মৃত্যু হয় শত্রুর।’’ তবে কর্নেল রায়ের কথায়, ‘‘এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত সম্পন্ন করতে হয়। প্রক্রিয়াটা বলতে যতটুকু সময় লাগে, কাজে করতে ততটুকুও সময় লাগলে চলে না।’’ ১৫ জুন রাতে ভারতীয় কম্যান্ডোরা চিনা ফৌজের অনেকের উপরেই সেই দাঁও-প্যাঁচ প্রয়োগ করেছিলেন বলে সেনা সূত্রে জানা যাচ্ছে।
ওই ঘটনার প্রেক্ষিতেই সীমান্তে মার্শাল আর্ট জানা টহলদারদের চিন এখন মোতায়েন করতে চাইছে বলে নয়াদিল্লির সমর বিশারদরা মনে করছেন। এলএসি-তে ভারতীয় সেনার মুখোমুখি মোতায়েনের জন্য মার্শাল আর্ট জানা যোদ্ধাদেরই সন্ধান শুরু করেছে পিপলস লিবারেশন আর্মি। খোঁজ চলছে প্রশিক্ষকেরও। সেই উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে জোরকদমে। সে দেশের সামরিক বাহিনীর মুখপত্র ‘চায়না ন্যাশনাল ডিফেন্স নিউজ’-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, ইতিমধ্যেই লালফৌজের পাঁচটি নতুন মিলিশিয়া ডিভিশন গড়া হয়েছে। তাতে রয়েছেন চিনের বিভিন্ন মার্শাল আর্ট ক্লাবের ছাত্র-শিক্ষক এবং ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্সের সময়ে এভারেস্ট শীর্ষে অলিম্পিক টর্চ নিয়ে যাওয়া পর্বতারোহীদের রিলে টিমের সদস্যেরা। চিনা ফৌজের সংবাদপত্রে অবশ্য গালওয়ান প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সন্তর্পণে। কিন্তু ভারতীয় সেনা সূত্রের দাবি, গালওয়ান থেকে শিক্ষা নিয়েই এই নতুন উদ্যোগ চিনা বাহিনীতে।
ভারত-চিন সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারে যে বিধিনিষেধ ছিল, তা শিথিল করে সম্প্রতি সেনাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে নয়াদিল্লি। বেজিং-ও পাল্টা হুমকি দিয়েছে। প্রয়োজনে কাশ্মীরে ঢুকবে চিনা বাহিনী— এমন মন্তব্যও করানো হয়েছে চিনা প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে। অর্থাৎ সীমান্তে এখন সঙ্ঘাত তৈরি হলে তা নিরস্ত্র সংঘর্ষই থেকে যাবে, এমন সম্ভাবনা কমই। সে কথা মাথায় রেখেও নিরস্ত্র সংঘর্ষের জন্য নিজেদের বাহিনীকে আরও বেশি প্রস্তুত করতে চাইছে বেজিং। সেই লক্ষ্যেই এ বার মার্শাল আর্টে জোর। মনে করছেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy