মাঝামাঝি একটা পথ বেরিয়ে এল ছ’বছর পর! শেষ মুহূর্তে ফের কোনও গেরোয় না আটকে গেলে, আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর টোকিও সফরেই সই হতে চলেছে ভারত-জাপান অসামরিক পরমাণু চুক্তি। এক ধাক্কায় যা শক্তিক্ষেত্রে ভারতকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দিতে পারে।
কেন আটকে ছিল এই চুক্তি? কী ভাবেই বা খুলল জট?
টোকিও চেয়েছিল, ভারত লিখে দিক, কোনও অবস্থাতেই আর পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাবে না। কিন্তু ঘাড়ের উপরে বেজিং এবং ইসলামাবাদ যে ভাবে নিশ্বাস ফেলছে, তাতে ভারতের পক্ষে এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া কার্যত অসম্ভব। আর এই মতবিরোধের জেরেই ছ’বছর ধরে ঝুলে ছিল এই অসামরিক পরমাণু চুক্তি। অবশেষে মিলেছে মধ্যপন্থা। স্থির হয়েছে, চুক্তিতে বলা থাকবে, ভারত পরমাণু বোমা ফাটালে সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে যাবে ওই পরমাণু চুক্তি।
দীর্ঘদিন ধরেই পরমাণু শক্তিধর হওয়া সত্ত্বেও পরমাণু সরবরাহকারী দেশগুলির গোষ্টী (এনএসজি)-তে ঠাঁই পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ভারতকে। এ ক্ষেত্রেও বড় বাধা চিন। এ বার জাপানের সঙ্গে ওই চুক্তির মাধ্যমে পরমাণু প্রশ্নে হিরোসিমা-র দেশের আস্থা পাকাপাকি ভাবে অর্জন করতে পারলে ভারতের জন্য পরমাণু বিশ্বের দরজা অনেকটাই খুলে যাবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা। চিনকেও একটা কড়া বার্তা দেওয়া যাবে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে গত কাল জাপানের নিরাপত্তা সচিব শোতারো ইয়াচি-র দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে স্থির হয়েছে, মোদীর আসন্ন জাপান সফরে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিলমোহর লাগানো হবে। অন্ধ্রপ্রদেশ এবং গুজরাতে দু’টি পরমাণু কারখানা গড়া নিয়েও কথা হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই চুক্তি হলে তা আমেরিকার পরমাণু সংস্থাগুলির পক্ষেও লাভজনক হবে। জিই-হিতাচি, তোশিবা-ওয়াশিংটন হাউসের মতো মার্কিন-জাপ সংস্থাও চায় দিল্লি-টোকিও পরমাণু চুক্তি হোক। কারণ, পরমাণু কারখানা গড়ার জন্য ইতিমধ্যেই তাদের জমি দিয়ে রেখেছে ভারত সরকার। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি হয়ে রয়েছে। কিন্তু জাপানের সঙ্গে চুক্তি না হলে চুল্লির অনেক যন্ত্রাংশ জাপান থেকে আমদানি করা সম্ভব হচ্ছিল না। চুক্তিটি হলেই দ্রুত তা শুরু করা যাবে।
অপ্রচলিত শক্তি ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে মনমোহন সিংহের জমানায় উৎসাহের অভাব ছিল না। জাপানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১০-এ। কিন্তু পরের বছর মার্চ মাসে জাপানের ফুকুশিমা দাইচির একাধিক পরমাণু চুল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটায় গোটা প্রক্রিয়াটিই থমকে যায়। নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় এসে জাপানের সঙ্গে চুক্তির পথ খুলতে যথা সম্ভব চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু সমস্যা হল, পরমাণু প্রশ্নে এমনিতেই জাপান বিশ্বের সব চেয়ে স্পর্শকাতর দেশ। তায় ভারত আবার পরমাণু অস্ত্রপ্রসার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-তে সই না-করা রাষ্ট্র। ফলে জাপানের সঙ্গে পরমাণু ক্ষেত্রে গাঁটছড়া বাঁধাটা জটিলতর ছিল।
২০০৮ সালে সর্বশেষ বিস্ফোরণ ঘটানোর পরে ভারত একতরফা ভাবেই পরমাণু পরীক্ষার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আজও সেটির অন্যথা করেনি। তবু টোকিও চেয়েছিল, চুক্তির বয়ানে এই দু’টি বিষয় অবশ্যই রাখতে হবে যে,
• ভারত আর পরমাণু পরীক্ষা করবে না (অর্থাৎ বোমা ফাটাবে না)। এবং
• ভারতের অসামরিক পরমাণু প্রকল্পগুলির দরজা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য খোলা রাখার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।
মোদী ক্ষমতায় আসার পরই দ্বিতীয় শর্তটি মেনে নিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে ভারত দু’বছর আগেই আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে একটি চুক্তি তথা ‘প্রোটোকল’ও সই করেছে। কিন্তু পরমাণু পরীক্ষা না-করার প্রতিশ্রুতি সাউথ ব্লক দিতে রাজি হয়নি। ধারাবাহিক দৌত্যের মাধ্যমে টোকিওকে বোঝানো হয়েছে, এমন কোনও প্রতিশ্রুতিতে দিল্লি নিজেকে বেঁধে ফেললে, চিন সাপের পাঁচ পা দেখবে! পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের কাছেও জুজু হয়ে থাকতে হবে। জাপানকে বোঝানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির এখন যে ঘনঘোর দশা, তাতে এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়াটা অবাস্তব শুধু নয়, ভারতের জাতীয় স্বার্থের বিরোধী। বরং জাপানের মতো দেশকে পাশে পেয়ে চিনকে কড়া বার্তা দিতেও ভারত তৈরি। বলা যায়, বেজিংয়ের পাক-প্রীতি ও অন্য কিছু কূটনৈতিক কারণে এ ব্যাপারে খানিকটা বাড়তি আগ্রহও রয়েছে দিল্লির। নিজস্ব কূটনৈতিক কারণে সে আগ্রহ জাপানেরও কম নয়। এর পর জাপানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, চুক্তিটিতে এমন অনুচ্ছেদ রাখতে হবে, যেখানে বলা থাকবে ভারত ফের পরমাণু পরীক্ষা করলে এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নিজে থেকেই বাতিল হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এই শর্তে রাজি হয়েছে ভারত।
অপেক্ষা এ বার নরেন্দ্র মোদীর জাপান-যাত্রার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy