Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

ভর্তুকির বোঝা কমবে কী ভাবে, দিশাহীন জেটলি

মুখে বলা যতটা সহজ, কাজে করা ঠিক ততটাই কঠিন। বাজেটে ভর্তুকির জগদ্দল পাথর সরাতে গিয়ে সেটাই টের পাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ডিজেল-রান্নার গ্যাস-কেরোসিনের মতো জ্বালানিতে এবং সর্বোপরি খাদ্য ও সারে ভর্তুকি কমাতে চাইছেন তিনি। কিন্তু কী ভাবে তা কমানো হবে, সেটাই হল প্রশ্ন।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

মুখে বলা যতটা সহজ, কাজে করা ঠিক ততটাই কঠিন।

বাজেটে ভর্তুকির জগদ্দল পাথর সরাতে গিয়ে সেটাই টের পাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ডিজেল-রান্নার গ্যাস-কেরোসিনের মতো জ্বালানিতে এবং সর্বোপরি খাদ্য ও সারে ভর্তুকি কমাতে চাইছেন তিনি। কিন্তু কী ভাবে তা কমানো হবে, সেটাই হল প্রশ্ন।

সাধারণ মানুষের কাছে সস্তায় জ্বালানি পৌঁছে দিতেই এই খাতে ভর্তুকি দেয় সরকার। ভর্তুকি কমানোর সহজ উপায় হল ডিজেল, রান্নার গ্যাস ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো। ক্ষমতায় এসেই ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়ানোয় বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে। সরকারের শীর্ষব্যক্তিরা বুঝতে পারছেন, এক দফায় অনেকখানি দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির বহর শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই ধাপে ধাপেই এগোতে হবে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে বৃষ্টিপাতে ঘাটতির সমস্যা ও ইরাকে অস্থিরতার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়া। বৃষ্টি কম হওয়ায় চাষিদের সেচের জন্য বেশি পাম্প চালাতে হবে। সেখানে এ বার আরও ভর্তুকি দিতে হবে বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রক। আবার বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়ায় আমদানির খরচ ঊর্ধ্বমুখী। ফলে পেট্রোল-ডিজেল বিক্রিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে বেশি পরিমাণে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে।

তেলের পাশাপাশি রয়েছে খাদ্য ও সারে ভর্তুকি। খাদ্যে ভর্তুকি কমানো তো দূরের কথা, খাদ্য সুরক্ষা আইন কার্যকর করতে হলে বেশি ভর্তুকি বরাদ্দ করতে হবে অরুণ জেটলিকে। একই ভাবে সারে ভর্তুকি কমিয়ে দিলেও কৃষকেরা সমস্যায় পড়বেন। খাদ্যসামগ্রীর দামও বাড়তে পারে।

অর্থনীতিবিদরা যুক্তি দিচ্ছেন, সরকার দু’ভাবে ব্যয় করে। পরিকল্পনা খাতে ও পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে। পরিকল্পনা খাতে ব্যয় হয় সামাজিক প্রকল্পে ও পরিকাঠামো তৈরিতে। সেখানে খরচ কমালে অর্থনীতিরই ক্ষতি। পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয় হয় প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের উপর সুদ মেটাতে, প্রতিরক্ষায় এবং ভর্তুকি খাতে। ডয়েশ ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ তৈমূর বেগ ও কৌশিক দাসের মতে, “এই তিনটির মধ্যে ভর্তুকির পিছনে ব্যয় কমানোর সুযোগ ও প্রয়োজন সম্ভবত সবথেকে বেশি। যদিও সেই কাজটা রাজনৈতিক ভাবে কঠিন।’’ তাঁদের ব্যাখ্যা, বছর বছর কেন্দ্রীয় ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। সুদের চড়া হারের জন্য সুদ বাবদ ব্যয়ও বাড়ছে। অর্থমন্ত্রীর পক্ষে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমানো সম্ভব নয়। বরং বাড়াতে হবে। বাকি থাকে ভর্তুকি।

গত আর্থিক বছরে (২০১৩-’১৪) খাদ্য, সার ও জ্বালানি বাবদ ভর্তুকির পিছনে কেন্দ্রের ব্যয় হয়েছিল ২ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করতে গিয়ে পি চিদম্বরম হিসেব দিয়েছিলেন, এ বছর ভর্তুকির পরিমাণ ২ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। যার মধ্যে খাদ্যে ভর্তুকি দিতে হবে ১ লক্ষ ১৫ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানির ভর্তুকি বাবদ তিনি ৬৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থা মুডিজ-এর হিসেবে, জ্বালানির পিছনে ভর্তুকি আরও বেড়ে ১ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছবে। মোট ভর্তুকির পরিমাণও বাড়বে। জেটলি এই ভর্তুকিতে কাটছাঁট করবেন বলেই আশা করছে মুডিজ।

কিন্তু কোন পথে? পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান বলছেন, দাম বাড়ানোটাই ভর্তুকি কমানোর একমাত্র উপায় নয়। রান্নার গ্যাসের দাম এখনই আর বাড়ানো হবে না বলে তাঁর দাবি। ডিজেলের ক্ষেত্রেও প্রতি মাসে লিটারে ৫০ পয়সা করে দাম বাড়ানোর ইউপিএ-সরকারের নীতিই মোদী সরকার অনুসরণ করবে বলে তাঁর ইঙ্গিত। সেই নীতি মানলে ডিজেলে ভর্তুকি শূন্যে নামতে এই বছর গড়িয়ে যাবে। ১৫ টাকা লিটার দামের কেরোসিনে এখন প্রায় ৩৩ টাকা করে ভর্তুকি দেয় কেন্দ্র। সেই ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনাও দূর অস্ত্। ধর্মেন্দ্রের যুক্তি, দাম না-বাড়িয়েও ভর্তুকি কমানো যায়। তাই কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন। কিন্তু কী সেই সংস্কারের কর্মসূচি, তা নিয়ে ধর্মেন্দ্র মুখ খুলতে নারাজ।

দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র ২.২ শতাংশ এখন ভর্তুকির পিছনে ব্যয় হয়। বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের সভাপতি, ইয়েস ব্যাঙ্কের সিইও রাণা কপূরের মত, “এই ভর্তুকির বহর জিডিপি-র ১.৮ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত। এ নিয়ে কোনও দর কষাকষিরই দরকার নেই। গরিবদের হাতে নগদ ভর্তুকি তুলে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে ধাপে ধাপে সব রকম জ্বালানির দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কর্মসূচিও নিতে হবে।”

শিল্পমহলের যুক্তি স্পষ্ট। আপাত ভাবে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে জ্বালানির দাম কমিয়ে রাখলে সাধারণ মানুষের সুরাহা হচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু ভর্তুকি দিতে গিয়ে আসলে সরকারকে বাজার থেকে ঋণ নিতে হয়। সরকার খুব বেশি ঋণ নিলে সুদের হারও বেড়ে যায়। সুদের হার বাড়লে উৎপাদন কম হয় বলে আর্থিক বৃদ্ধির হারও কমে। ফলে সরকারের কর বাবদ আয়েও ভাটার টান দেখা দেয়। এর কারণ, শিল্প সংস্থাগুলিকে বেশি সুদ দিয়ে ঋণ নিতে হয়, যে কারণে উৎপাদনের খরচ বাড়ে, উৎপাদন কমে আসে এবং মূল্যবৃদ্ধি হয়। তাই শেষ রক্ষা হয় না। দীর্ঘ মেয়াদে সাধারণ মানুষের কিছুই সুরাহা হয় না। ভর্তুকি দেওয়াটা তাই রাজনীতির মাপকাঠিতে ভাল হলেও অর্থনীতির মাপকাঠিতে বোকামি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy