ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়েছেন ডেরেক। —নিজস্ব চিত্র
সংবাদমাধ্যম তো নয়ই, রাজ্যসভা-লোকসভার বিরোধী সাংসদদের পর্যন্ত হাথরসের দলিত পরিবারটির ধারে-কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না উত্তরপ্রদেশের পুলিশ-প্রশাসন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ আজ ঘোষণা করে দিয়েছেন, তাঁর রাজ্যে ‘মা-বোনেদের’ সঙ্গে অশালীন আচরণ করে ছাড় পাবে না কেউ। অভিযুক্তদের তিনি এমন শাস্তি দেবেন যা আগামী প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এর পরে তদন্ত দলের সুপারিশ মেনে হাথরসের এসপি এবং চার পুলিশকে সাসপেন্ড করেছে যোগী সরকার। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা পাল্টা বলেছেন, কয়েক জন আজ্ঞাবহকে সরিয়ে লাভ নেই। দেশবাসী এখন নির্দেশদাতাদের এবং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ইস্তফা দেখতে চাইছেন।
বিরোধী নেতানেত্রীদের সঙ্গে অভব্য আচরণ আজও বজায় রেখেছে যোগীর প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রী তা নিয়ে নীরবই। কাল কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর সঙ্গে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ যা করেছে, আজ কার্যত তারই পুনরাবৃত্তি হল তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত কালই দলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, শুক্রবার যত দ্রুত সম্ভব হাথরসের নির্যাতিতার পরিবারের কাছে পৌঁছতে হবে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশ যাতে আগাম সতর্ক হয়ে পথরোধ করতে না পারে, সে জন্য যথাসম্ভব গোপনীয়তা বজায় রেখে আজ সকালে পৃথক চারটি গাড়িতে দিল্লি থেকে বুল গড়হী গ্রামের উদ্দেশে রওনা হন তৃণমূলের তিন বর্তমান এবং এক প্রাক্তন সাংসদ। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। নির্যাতিতার পরিবারের কাছে পৌঁছতে পারেননি ডেরেক ও’ব্রায়েন, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রতিমা মণ্ডল এবং মমতা ঠাকুর।
গ্রামে ঢোকার মুখে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়, ধস্তাধস্তিও হয়। এক পুলিশ কর্তা ধাক্কা মারেন প্রতিমাকে। তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেকও ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যান। গোটা ঘটনার প্রতিবাদে তৃণমূলের নেতারা পদযাত্রা করে হাথরস থানায় যান এবং ওই পুলিশ কর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। ডেরেক জানান, হাথরস থানায় তাঁদের করা অভিযোগের কপি পাঠানো হবে লোকসভার স্পিকারকে।
আরও পড়ুন: বাড়ি ঘিরেছে পুলিশ, জেঠার বুকে লাথি মেরেছে: নির্যাতিতার ভাই
মহিলা সাংসদেরা আজ গায়ে জড়িয়েছিলেন, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও— লজ্জা’ স্লোগান লেখা সাদা চাদর। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তৃণমূলের প্রতিনিধি দলের তিন জন নারী সদস্যের এক জন ছিলেন তফসিলি জাতি এবং এক জন জনজাতিভুক্ত।
দেখুন ভিডিয়ো:
পরে ডেরেক বলেন, “এক জন মহিলা সাংসদের গায়ে এক জন পুলিশ কর্তা হাত দেওয়ার সাহস পান কী ভাবে? আমি এই প্রশ্ন তোলায় আমাকেই ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হল। জঙ্গলের রাজত্ব চলছে যোগীর উত্তরপ্রদেশে। আমরা নেত্রীর নির্দেশে নির্যাতিতার পরিবারের কাছে যেতে চেয়েছিলাম। শুধু আটকই নয়, চূড়ান্ত হেনস্থা করেছে পুলিশ।’’
দুপুর বারোটা থেকে বেলা তিনটে— তিন ঘণ্টা সেখানে ধর্নায় বসেন তৃণমূল সাংসদেরা। এসপি নেতা অখিলেশ সিংহ যাদব এবং রামগোপাল যাদব ফোনে কথা বলেন ডেরেকের সঙ্গে। সূত্রের খবর, নির্যাতিতার পরিবারের কাছে থেকে মোবাইলও নিয়ে নেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা বাইরে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন।
যন্তর মন্তরে স্বরা ভাস্কর ও চন্দ্রশেখর আজ়াদ। ছবি: পিটিআই।
থরসের নির্যাতিতার মৃত্যু আর তড়িঘড়ি তাঁর দেহ পুলিশ পুড়িয়ে ফেলার পর থেকেই প্রবল চাপে যোগী প্রশাসন। আবার হাথরসের উচ্চবর্ণের বাসিন্দারা মহাপঞ্চায়েত ডেকে গ্রেফতার হওয়া দুষ্কৃতীদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেছে। সিবিআই তদন্ত না করলে আন্দোলন শুরুর হুমকি দিয়েছেন তাঁরা। উচ্চবর্ণের বাসিন্দাদের বক্তব্য, পুলিশ যখন বলছে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি, কাউকে আটক করে রাখাও চলবে না। এই চাপানউতোরের মধ্যে দাহের ৪৮ ঘণ্টা পরেও নিভে যাওয়া চিতায় পড়ে রয়েছে নির্যাতিতার অস্থি। পরিবারের কাউকে তা বিসর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। পাশে কেরোসিনের জার, হাতশুদ্ধির আধখালি বোতল।
আরও পড়ুন: খবর রুখতে মরিয়া পুলিশ
হাথরসের পর উত্তরপ্রদেশে নাবালিকা ও কিশোরী ধর্ষণের পর পর কয়েকটি ঘটনা সামনে এসেছে। রাজ্যের নারী সুরক্ষা নিয়ে আগেই প্রশ্ন তুলেছিলেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। আজ তিনি হরিজন সম্প্রদায়ের একটি মন্দিরে প্রার্থনায় অংশ নেন। পরে টুইটে বলেন, ‘কয়েক জন আজ্ঞাবহ পাহারাদারকে সাসপেন্ড করে কী বোঝাতে চাইছেন যোগী। যাদের নির্দেশে এই কাজ করা হয়েছে, তাদের সরাতে পারলে সরান। আপনি নিজে ইস্তফা দিন। গোটা দেশ আজ আপনার ইস্তফা দেখতে চাইছে।’ দিল্লি থেকে লখনউ— বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতির নেতা-নেত্রীরা।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই দিল্লির যন্তর মন্তরের সামনে আজ বিক্ষোভ-সমাবেশে অংশ নেন বহু মানুষ। আইনজীবী তথা সমাজকর্মী প্রশান্ত ভূষণ ওই সমাবেশে বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে এখন গুন্ডারাজ চলছে। বিরোধী, সংবাদমাধ্যম কাউকে হাথরসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। নির্যাতিতার পরিবারের কাছ থেকে মোবাইল ফোনটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারেন।’’ শিবসেনার সঞ্জয় রাউত আজ যোগী প্রশাসনকে বিঁধে বলেন, ‘‘রাহুল গাঁধীর সঙ্গে আমাদের মতের অমিল থাকতে পারে, কিন্তু এক জন সর্বভারতীয় নেতাকে যোগীর পুলিশ কাল যে ভাবে কলার ধরে হেনস্থা করেছে, মনে হচ্ছে এ দেশে এখন গণতন্ত্রের গণধর্ষণ চলছে।’’ সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরিও বিরোধী নেতা ও সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের উপর উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বর্বরতার নিন্দা করে বলেন, “যোগীরাজ্যে মানবাধিকার বিপন্ন।”
লখনউয়েও আজ বিক্ষোভ-অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছিল সমাজবাদী পার্টি। কিন্তু হজরতগঞ্জে এসপি কর্মীদের উপরে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। বেশ কয়েক জন বিধায়ককে গ্রেফতার করা হয়। পরে দলের নেতা তথা অখিলেশ যাদব বলেন ‘‘লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং মোহনদাস গাঁধীর জন্মদিনে আমাদের নেতা-নেত্রীদের গ্রেফতার করে সত্যের কণ্ঠরোধ করা হল!’’
তবে শুধু বিরোধীরাই নন, নিজের দলের নেতা-নেত্রীদের কাছেও এখন কটাক্ষ শুনতে হচ্ছে যোগীকে। নির্যাতিতার পরিবার তথা গোটা গ্রাম পুলিশ ঘিরে রাখায় গোটা দেশের কাছে অন্য বার্তা যাচ্ছে বলে আজ যোগীকে বিঁধেছেন তাঁরই দলের নেত্রী উমা ভারতী। আজ এক লিখিত বার্তায় তিনি যোগীকে বলেছেন, ‘‘আমরা রামরাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখি। কয়েক দিন আগেই রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়েছে। কিন্তু আপনার পুলিশ যে ভাবে ওই নিপীড়িত পরিবার তথা গোটা গ্রামকে নজরবন্দি করে রেখেছে, তাতে গোটা দেশের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে।’’ বিরোধী নেতা ও সংবাদমাধ্যম যাতে গ্রামে ঢুকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, সে জন্য ‘দিদি হিসেবে’ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন প্রবীণা উমা।
তবে এত কিছুর পরেও হাথরসের ঘটনাকে ‘ছোট ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেছেন যোগী সরকারের মন্ত্রী অজিত সিংহ পাল। উত্তরপ্রদেশের তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘মহিলা যে ধর্ষিতা হননি, পুলিশ ইতিমধ্যেই তা জানিয়েছে। তার পরে এমন একটা ছোট ঘটনা নিয়ে হাওয়া গরম করার চেষ্টা চলছে’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy