শরদ পওয়ার। —ফাইল চিত্র।
তিনি ছিলেন জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধী ঐক্যের অন্যতম প্রধান মুখ। তাঁর দিল্লির বাসভবনে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন স্তরের বৈঠকে শামিল হয়েছেন বিরোধী নেতারা।
আজ ভাইপো অজিত পওয়ারের দাবার চালে রথের চাকা মাটিতে বসে গেল মরাঠার ‘স্ট্রংম্যান’ শরদ পওয়ারের। শুধু নিজের রাজ্যে নয়, জাতীয় স্তরের বিরোধী রাজনীতিতেও একধাক্কায় অনেকখানিই গুরুত্ব কমে গেল পওয়ারের। যদিও রাজনৈতিক সূত্রে আরও একটি তত্ত্বও রয়েছে। তা হল, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার জাল যে ভাবে তাঁকে এবং তাঁর দলকে ঘিরে ধরেছিল, তা থেকে বাঁচতে পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ শরদ নিজেই নেপথ্যে থেকে অজিতকে বিজেপি শিবিরে ভিড়িয়ে দিয়েছেন। যাতে তদন্ত গতি হারায়।
প্রাথমিক ভাবে বিরোধী শিবিরের আশঙ্কা, পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে মহারাষ্ট্রে ভাল ফল করার সম্ভাবনা বাড়ল বিজেপির। আগামী বছর মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনেও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা মোদী-অমিত শাহের দলের। এটাও মনে করা হচ্ছে, জাতীয় বিরোধী রাজনীতির রাশ ধরা ও ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নে পওয়ার একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ায় রাহুল গান্ধী তো বটেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্বও আরও বাড়বে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, এনসিপি-র কাছে এমনিতেও লোকসভায় বিরাট কোনও সংখ্যা ছিল না। কিন্তু শরদ পওয়ারের ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছিল। তাঁর কথায়, “একটি গ্যাস বেলুন ছিল বলা যায়। যা আজ ফুটো হয়ে গেল।”
আজ কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি অবশ্য প্রকাশ্যেই পওয়ারের পাশে থেকেছে। রাহুল এবং মমতা পওয়ারের সঙ্গে কথা বলে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির দল ভাঙানোর রাজনীতির নিন্দা করেছেন বিরোধী নেতারা। রাহুল এবং মমতার পওয়ারকে ফোন করাটা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। সাভারকর বিতর্কে সম্প্রতি পওয়ারের সঙ্গে মনান্তর হয়েছিল রাহুলের। অন্য দিকে, গত বছর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর থেকে পওয়ারের প্রতি মমতার ‘অ্যালার্জি’ সর্বজনবিদিত। তবে মনে করা হচ্ছে,বিজেপি-বিরোধী স্বরকে চাঙ্গা রাখার খাতিরেই আজ শরদের দলে এত বড় ভাঙনের পরেও রাহুল এবং মমতা ফোন করেছেন তাঁকে।
আজকের ঘটনায় বিরোধীদের মধ্যে আরও একটা আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বিরোধী ঐক্য গড়ে তুলতে তুলতেই আরও কেউ শিবির বদল করবেন কি না, আশঙ্কা তা নিয়ে। কারণ, পটনার বিরোধীদের বৈঠকে পওয়ার ও সুপ্রিয়া সুলের সঙ্গে আগাগোড়া উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ এনসিপি নেতা প্রফুল্ল পটেল। তিনিও আজ হাত মিলিয়েছেন বিজেপির সঙ্গে। এক বিরোধী নেতার মতে, তা হলে তো ধরে নিতে হবে, বিরোধী বৈঠকের ভিতরেই বিজেপির ‘চর’ ছিল! অন্য দিকে বিরোধীদের বরাবরের ‘গলার কাঁটা’ আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল বলেছেন, “মহারাষ্ট্রে পালা করে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়েছে বিজেপি আর কংগ্রেস।” বেঙ্গালুরু বৈঠকের আগে বিরোধী ঐক্যের প্রশ্নে এই মন্তব্য যথেষ্ট অস্বস্তির। আজকের ঘটনার পর বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বাম এবং জেডি(এস) শিবিরেও।
বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, আজকের ঘটনার পরে শরদের গুরুত্ব অনেকটাই কমে যাওয়াটা কংগ্রেস বা তৃণমূলের কাছে স্বস্তির। আরও একটি মতবাদ হল, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার চাপ পওয়ারের উপরেও রয়েছে। ২০২৪-এর আগে তিনিও শেষ পর্যন্ত বিজেপির হাত ধরতে পারেন। এই একই কারণে তিনি রাজি হয়েও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীর পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন শেষ মুহূর্তে।
কংগ্রেস নেতা কে সি বেণুগোপাল আজ টুইট করে বলেছেন, “মহারাষ্ট্রে বিজেপির নোংরা কলাকৌশলের খেলা চলছেই। এটা কোনও নিয়মমাফিক তৈরি হওয়া সরকার নয়, বরং ইডি-র দাপটে ক্ষমতা দখল। মহারাষ্ট্র সরকার দুর্নীতি এবং পাপের আখড়া হয়ে উঠেছে। মানুষ এই সব বিশ্বাসঘাতক, দুর্নীতিবাজ নেতাদের চিনে নিচ্ছেন, পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে এদের শিক্ষা দেওয়া হবে।” বাংলার মন্ত্রী তথা তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র বাবুল সুপ্রিয় বলেছেন, “চব্বিশের নির্বাচনে বিশ্বাসঘাতকেরা হারবে। বিজেপিকে হারানোর জন্য আমাদের প্রতিজ্ঞা আরও শক্তি পেল এই ঘটনায়।’’
পওয়ার যে মরাঠা রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে জাতীয় স্তরে নিজের দর বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, এমন আঁচ আগেই মিলেছিল বলে দাবি তৃণমূলের। কংগ্রেস, তৃণমূল, ডিএমকে অথবা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে পরামর্শ না-করেই সম্প্রতি নিজের রাজ্যে মরাঠিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে পটনা-পরবর্তী বিরোধী বৈঠকের (বেঙ্গালুরু) তারিখ (১৪ জুলাই) একতরফা ঘোষণা করেন।
তৃণমূলের মতে, জাতীয় বিরোধী রাজনীতির প্রশ্নে, ‘গাঁয়ে না চাইলেও আপনি মোড়ল’ হয়ে উঠেছিলেন পওয়ার। সে কারণে কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে বিরোধী বৈঠকের ঘোষণা করেন। সূত্রের খবর, পওয়ারের সে দিনের ঘোষণামাফিক ১৪ তারিখ বেঙ্গালুরুতে বৈঠক হচ্ছে না। দিন চূড়ান্ত নিয়ে এখনও কথা চলছে। প্রাথমিক ভাবে স্থির হয়েছে, ১৭-১৮ জুলাই বৈঠকটি হতে পারে। কারণ ২০ তারিখ সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হবে। ২১ তারিখ তৃণমূলের শহিদ দিবসের অনুষ্ঠান। তাই সব দিক বিবেচনা করে ওই সময় স্থির করা হচ্ছে। যদিও অন্য এক সূত্রের খবর, বাদল অধিবেশনের আগে বৈঠক না-ও হতে পারে।
রাজনৈতিক শিবিরের মতে, প্রাথমিক ভাবে ১৪ জুলাই বৈঠকের কথা স্থির হলেও সেটা পওয়ারের ঘোষণা করার কথা ছিল না। পটনার বৈঠকের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, কংগ্রেস, তৃণমূল বা ডিএমকে-র নেতারা সে ভাবেই চাইছিলেন, নীতীশ কুমারই তা সংবাদমাধ্যমকে জানাবেন। কিন্তু পওয়ার বিরোধী বৈঠকের দিন ঘোষণা করায় ঘরোয়া ভাবে ক্ষোভ জানান কংগ্রেস এবং তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা।
তবে যাঁকে ঘিরে এ সব ক্ষোভ-বিক্ষোভ, সেই ‘মরাঠা স্ট্রংম্যান’ আপাতত অতীতের ছায়া হয়ে গেলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy