সৌরভ কেন ত্রিপুরা সরকারের প্রস্তাবে রাজি হলেন? এমন নয় যে, তিনি জানতেন না, এর ফলে ‘রাজনৈতিক জল্পনা’ তৈরি হবে। —ফাইল চিত্র।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কি আবার বিজেপির ‘কাছাকাছি’? পদ্মশাসিত ত্রিপুরার পর্যটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হতে তিনি রাজি হয়ে যাওয়ায় সেই প্রশ্ন আবার নতুন করে উঠতে শুরু করেছে। ঘটনাচক্রে, যে দিন বিষয়টি প্রকাশ্যে এল, সে দিনই কেন্দ্রে বিজেপির বিরোধী জোট নিয়ে নবান্নে আপ-এর দুই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে ‘দাদা’র এই পদক্ষেপ ‘দিদি’ কী ভাবে নিলেন, তা নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছে। যদিও মমতার তরফে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
২০২১ সালের আগে সৌরভকে সরাসরি বাংলার বিধানসভা ভোটে তাদের ‘মুখ’ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল বিজেপি। বিভিন্ন টালবাহানা করে তিনি তখন পিছিয়ে যান। তার পর থেকে সৌরভের সঙ্গে বিজেপির ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে, এমন কথা কেউ না বললেও কেন্দ্রের শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যে বাড়তি ‘মসৃণ’ হয়েছে, তেমনও নয়। বস্তুত, অনেকেই মনে করেন, বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কের ‘জটিলতা’র কারণেই সৌরভকে বিসিসিআইয়ের সভাপতির পদ হারাতে হয়েছে। যে পদ, ক্রিকেটমহলের অনেকেই জানেন, শেষমুহূর্তে তিনি পেয়েছিলেন বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের বদান্যতায়।
ত্রিপুরার বিজেপি সরকারের তরফে সৌরভকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তা তিনি মেনে নিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে নিয়ে আবার রাজনৈতিক জল্পনা শুরু হয়েছে। বিজেপির নেতারা মনে করছেন, সৌরভকে ত্রিপুরা সরকারের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নিয়োগ করা হয়েছে, এই তথ্যের চেয়েও যেটা বড় করে দেখানো গিয়েছে, তা হল— বাংলার মহারাজকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নিয়োগ করেনি! বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায় সেটা আরও স্পষ্ট। যিনি বলেছেন, ‘‘বাংলায় অনেক কৃতী এবং যশস্বী মানুষ রয়েছেন। যাঁরা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও বিখ্যাত। সৌরভ তাঁদেরই একজন। কিন্তু তাঁকে রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নিয়োগ না করে শাহরুখ খানকে বাইরে থেকে এনে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়েছে! উনি তো বহিরাগত।’’
সুকান্তের বক্তব্যের দু’টি অংশ রয়েছে। এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সৌরভকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। দুই, যে ‘বহিরাগত’ তত্ত্বে মমতা-সহ তৃণমূলের আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে বিজেপি, শাহরুখের উল্লেখ করে সেই তত্ত্বকেই পাল্টা আক্রমণ করা। এবং তার পাশাপাশিই সূক্ষ্ম ভাবে এক ‘মুসলিম’ তারকাকে রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নিয়োগ করার বিষয়টিও উস্কে দেওয়া। যদিও শাহরুখের আবেদন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের কাছেই একই রকম। ঘটনাচক্রে, সৌরভ-শাহরুখ সম্পর্কও খুব ‘মসৃণ’ নয়। আইপিএল থেকে যার শুরু। প্রকাশ্যে অবশ্য তার কোনও রেশ কখনওই দেখা যায়নি। ফলে অনেকের প্রশ্ন— এতদ্বারা কি মমতা এবং শাহরুখ, দু’জনকেই কোনও বার্তা দিতে চাইলেন সৌরভ?
যদিও অনেকেই বলছেন, এর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা অর্থহীন। ত্রিপুরা বাংলার ক্রিকেটার ঋদ্ধিমান সাহাকে নিয়েছে তাদের রাজ্যদলকে শক্তিশালী করার জন্য। তারা সেই দলের ডিরেক্টর করে আনতে চাইছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন অলরাউন্ডার ল্যান্স ক্লুজনারকে। সেটা যেমন একেবারেই ক্রিকেটীয় কারণে, সৌরভকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করাও সিদ্ধান্তও তেমনই ‘ত্রিপুরা’ ব্র্যান্ডকে আরও শক্তিশালী করার জন্য।
তবে সৌরভ থাকবেন আর রাজনীতি থাকবে না, সেটাও সম্ভব নয়। বিশেষত, যখন তাঁর নিজেরও রাজনীতিতে আগ্রহ ষোল আনার উপরে আঠারো আনা। তবে একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, সৌরভ কোনও ভাবেই মমতার সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করতে চান না। শাসকদলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল। যেমন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা তৎকালীন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই ছিল।
তা হলে সৌরভ কেন ত্রিপুরা সরকারের প্রস্তাবে রাজি হলেন? এমন নয় যে, তিনি জানতেন না, এর ফলে ‘রাজনৈতিক জল্পনা’ তৈরি হবে। বিষয়টি যে আকস্মিক ভাবে ঘটেছে, তা-ও নয়। ফলে মনে করা হচ্ছে, তিনি ভেবেচিন্তেই সম্মতি দিয়েছেন। এখন কথা হল, এই সম্মতি কি আসলে ‘বার্তা’? যে বার্তার নিহিত অর্থ হল তাঁকে আবার ক্রিকেট প্রশাসনে জায়গা করে দেওয়া হোক? কারণ, ধারাবিবরণী দেওয়ার চেয়ে ক্রিকেট প্রশাসক হিসাবে সৌরভ অনেক স্বচ্ছন্দ। তার চেয়েও অবশ্য তাঁর কাছে বেশি কাম্য ভারতীয় দলের কোচের ভূমিকা। সেই সম্ভাবনার দরজা খোলার ইঙ্গিতই কি ‘ত্রিপুরা ফ্যাক্টর’ দিচ্ছে? অনেকের মতে, সৌরভ একটি কভার ড্রাইভ মেরেছেন। আবার অনেকে বলছেন, কভার ড্রাইভ নয়, আপাতত আলতো পুশ করে বিজেপির স্কোরবোর্ডে খুচরো রান কিছু বাড়িয়ে রাখলেন বাংলার ‘দাদা’।
এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না। সৌরভ তো নয়ই। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, এটি সম্পূর্ণ ত্রিপুরা সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। সৌরভের গ্রহণযোগ্যতাকে যদি এবং বাংলাভাষী রাজ্য কাজে লাগায়, সেটা তো আনন্দের বিষয়।’’
ত্রিপুরার পর্যটনমন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী জানিয়েছেন, আইপিএল চলাকালীনই তাঁরা সৌরভের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সৌরভ তখনই নীতিগত সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দিল্লিতে থাকায় বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়নি। তাঁর দলের আইপিএল অভিযান শেষ হওয়ার পর সৌরভ কলকাতায় ফেরামাত্রই ত্রিপুরার পর্যটনমন্ত্রী সুশান্ত তাঁর দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে মঙ্গলবার সৌরভের বাড়িতে যান। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহার সঙ্গেও সৌরভের একপ্রস্ত কথা হয় বলেই খবর। তার পরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। জুনের প্রথমে সৌরভের লন্ডনে যাওয়ার কথা। তিনি ফিরলে তাঁর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হওয়ার বিষয়টি খাতায়কলমে মিটিয়ে ফেলা হবে বলেই জানা যাচ্ছে। তার পরে সৌরভ ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় যেতে পারেন।
বাংলাভাষী রাজ্য হিসেবে ত্রিপুরাই যে সৌরভকে তাঁর ‘প্রাপ্য সম্মান’ দিচ্ছে, সেটা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন দলের নেতারা। ত্রিপুরা বিজেপির এক নেতা যেমন সরাসরিই বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ ওঁকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। ত্রিপুরা দিয়েছে। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির এখন যা অবস্থা, তাতে তারা বোধ হয় কাউকেই কোনও সম্মান দেওয়ার জায়গায় নেই!’’
সৌরভ বিজেপি শাসিত ত্রিপুরার ব্র্যান্ডদূত হওয়ার বিষয়টির উপরে তৃণমূলও যে একেবারে নজর রাখছে না, তা নয়। তবে এটি এমনই একটি সিদ্ধান্ত, যা নিয়ে তারা সৌরভের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতেও পারছে না। তবে দলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ মন্তব্য করেছেন, ‘‘সৌরভ বরাবরই ভাল অলরাউন্ডার। তিনি কোনও মাঠে ব্যাট ধরেন, কোনও মাঠে বল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy