আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, দিব্যি আছেন মদন। কিন্তু পোড়খাওয়া রাজনীতিক তিনিও সম্ভবত বুঝতে পারছেন, তাঁকে আর কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সোমবার শেষ বিকেলে যখন তাঁর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, তখন তিনি আসানসোলের কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে একটু চা আর টোস্ট নিয়ে বসেছেন। এই অবেলায় চা-টোস্ট? তিনি বললেন, ‘‘আসলে দুপুরে ভাতটা খাওয়া হয়নি।’’ আরও জানালেন, বিকেলে বেরোবেন। তার পরে পাঞ্চেৎ জলাধার আর এ দিক-সে দিক ঘুরে কলকাতা ফিরবেন।
তিনি কি সত্যি সত্যিই রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভাবছেন?
মদন মিত্র নীরব রইলেন। কিছু ক্ষণ ফোনের ও-প্রান্ত থেকে পাউরুটি চিবোনোর শব্দ ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। তার পর ইতস্তত ভেসে এল ‘অ্যালঝাইমার্স’, ‘হ্যালুসিনেশন’...। বুঝলাম, নীরবতাটাই আসল জবাব। ওই ঝুম হয়ে থাকা লোকটাই আসল মদন মিত্র। যিনি প্রশ্নটার মোকাবিলা কী ভাবে করবেন বুঝতে না পেরে থম মেরে গিয়েছেন। কিন্তু সেটা বুঝতেও দিতে চাইছেন না। তাই কয়েক মুহূর্তের নীরবতার গণ্ডিটা পেরিয়ে আবার ‘ধিনা ধিন ধা’ হয়ে গিয়েছেন।
এসএসকেএম হাসপাতাল নিয়ে যখন তিনি সান্ধ্যভাষায় বিবিধ বাণী দিয়ে যাচ্ছেন, যা প্রতি দিন বদলে বদলে যাচ্ছে, তখন ফ্ল্যাশব্যাকে আসল এবং পুরনো মদনকে দেখার চেষ্টা করছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একেবারে শুরুর দিকে যাঁরা ছিলেন, মদন তাঁদের একজন। বস্তুত, তাঁদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন। ‘পরিবর্তনের সরকার’ ক্ষমতায় আসার পর তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন বটে। তার আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি কেন্দ্র থেকে বিধায়কও। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত মদন মূলত তৃণমূলের ‘জোগাড়ে’ হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন। অর্থাৎ লোক জোটাও, গাড়ি জোটাও। দ্রুত মিছিল সংগঠিত করতে হবে। ডাকো মদনকে! কোথাও বিক্ষোভ অর্গানাইজ় করতে হবে। ডাকো মদনকে! ঝটপট একটা সাংবাদিক বৈঠক ডাকতে হবে। মিডিয়াকে খবর দেবে কে? তারা আসার পরে সামলাবে কে? ডাকো মদনকে! ছোট আঙারিয়ার বক্তার মণ্ডলকে কোথায় রাখা হবে? ডাকো মদনকে! ওর ২৪ চৌরঙ্গি রোডে একটা অফিস আছে তো। সেখানেই থাকবে। তৃণমূল যখন ক্রমে রাজ্যে প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে উঠেছে, মদনও তখন ধীরে ধীরে ‘ডাকাবুকো’ হয়ে উঠছেন। ব্যস্ত হয়ে উঠছেন নিজস্ব ‘ব্র্যান্ড’ তৈরিতে।
কংগ্রেসের থাকাকালীনই সোমেন মিত্রের অন্যতম অনুগামী মদন হাবেভাবে ছিলেন, যাকে বলে, ফুলটু কংগ্রেসি। হেক্কোড়। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত। একদা কংগ্রেসের এক প্রতাপশালী নেতা বলেছিলেন, ‘‘ব্রাদার, গাড়ির ড্যাশবোর্ডে যদি দিল্লি-কলকাতার কয়েক গোছা ওপেন টিকিট না থাকে, তা হলে আর কিসের কংগ্রেস করলাম!’’ যেমন রাষ্ট্রপতি থাকার সময় রাইসিনা হিল্সের রাজকীয় প্রাসাদের প্রায় একাকী বাসিন্দা প্রণব মুখোপাধ্যায় সম্ভবত খানিকটা মর্মযন্ত্রণা থেকেই বলতেন, ‘‘ঘরের দরজার বাইরে যদি ১০০ জোড়া জুতোই না-থাকল, তা হলে আর কিসের পলিটিশিয়ান!’’
মদন ছিলেন তাঁদেরই অনেক ছোট মাপের, কিন্তু নির্ভুল প্রতিভূ। প্রণববাবুর মতো অর্থনীতির পণ্ডিত তিনি নন। ফলে সেই আভিজাত্যটা তাঁর কাছ থেকে আশা করা অন্যায়। মদন বরং অনেক বেশি ‘মাঠো’ কংগ্রেসি ছিলেন। যাঁদের পাড়ায়-পাড়ায় দেখা যেত। পাঞ্জাবির বুকের দু’তিনটে বোতাম খোলা, যাতে গলার সোনার মোটা চেন দেখার জন্য কষ্ট করতে না হয়। এমনিতেই চোখে পড়ে। পায়ে ঢাউস স্নিকার্স (এ রাজ্যে অ-বামপন্থী নেতাদের পায়ে সাদা চটির বদলে স্নিকার্সের আমদানি করেছিলেন অজিত পাঁজা। কিন্তু তাকে ‘কুলীন’ করেছিলেন মদনই)। বাঁ হাতের কব্জিতে রোল্ডগোল্ডের ঘড়ি। ডান হাতের কব্জিতে বাঁধা লাল রঙের আপাত-মন্ত্রপূত তাগা (এখন অবশ্য সেখানে হাতি বাঁধার শিকলের মতো মোটা সোনার রিস্টলেট)। দু’হাতের দশ আঙুলে নয়-নয় করে গোটা ছয়েক গ্রহরত্ন সম্বলিত সোনার আংটি। তীক্ষ্ণ রসবোধ (পরিচিতদের কাছে কখনও-সখনও আদিরসবোধ), সব সময় হাজির-জবাব এবং ছাপার অক্ষরে নাম দেখার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা।
কংগ্রেসে ছিলেন পার্শ্বচরিত্র। কিন্তু মমতার অনুবর্তী হয়ে মদন তৃণমূলে আসার পরে মুকুল রায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক-সহ অনেকের মতো তাঁরও ‘গ্র্যাজুয়েশন’ হল। তিনি ঝট করে সামনের সারিতে চলে এলেন। তার অন্যতম কারণ, তৎকালীন সাংবাদিককুলের সঙ্গে তাঁর সখ্য। মনে আছে, আনন্দবাজার পত্রিকায় কোনও কোনা খামচিতেও নাম বেরোলে সাতসকালে ফোন করে বলতেন, ‘‘আজ নন্দবাজারে (কেন জানি না, আনন্দবাজারকে ভালবেসে ‘নন্দবাজার’ বলতেন) নাম! আজ বাড়িতে ফুল মটন (‘মাটন’ নয়। ‘মটন’)!’’ অর্থাৎ, এক নম্বর কাগজে নাম বেরিয়েছে। সে দিন বাড়িতে পাঁঠার মাংসের ঝোলভাতের মহোৎসব। পরের দিকে অতখানিও বলতেন না। ফোনে অদ্ভুত তৃপ্তিমাখা দুটো শব্দ ভেসে আসত, ‘‘মাংস! মাংস!’’ আরও পরে গিয়ে সেটার একটা আশ্চর্য সংক্ষিপ্তসার আমার আর মদনের মধ্যে কোড ওয়ার্ড হয়ে গেল— মাংচুং! কোথাও দেখা হলেই ‘মাংচুং!’ ফোনে ‘হ্যালো’র বদলে সেই ‘মাংচুং’!
কেন যে ওই শব্দটা বলতেন, কোথা থেকে যে আবিষ্কার করেছিলেন, কে জানে! কিন্তু বলার সময় স্নেহসিক্ত বিড়ালের গলা থেকে যেমন একটা ঘড়ঘড়ে আদুরে আওয়াজ বেরোয়, তেমন তাঁর গলাতেও শোনা যেত। যেনতেনপ্রকারেণ ভেসে থাকতে হবে— নিজের কাছে এই মরণপণ প্রতিজ্ঞা ছাড়াও প্রথাসিদ্ধ কংগ্রেসিদের মতো আরও দুটো বিষয় প্রথম থেকেই মদনের মধ্যে ছিল। এক, দল এবং রং না দেখে লোককে সাহায্য করা (এটা সুভাষ চক্রবর্তীর মধ্যেও ছিল)। দুই, রাজকীয় মেজাজ।
প্রথমটার একাধিক উদাহরণ নিজের চোখে দেখা। কিছু শোনা। শোনাগুলোর মধ্যে কয়েকটা বলি। ট্যাক্সিতে ওয়ালেট ফেলে চলে এসেছেন। গাড়ির নম্বর-টম্বর কিচ্ছু জানা নেই। তাতে কী! ফোন লাগাও ‘প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেন্স ইউনিয়ন’-এর সভাপতি মদন মিত্রকে। ভোজবাজির মতো তিনি ড্রাইভার-সমেত ট্যাক্সি নিয়ে আসবেন। সেই বশংবদ চালক সেলাম করে দরকারি নথিপত্র এবং যাবতীয় সম্পদ-সহ ওয়ালেট ফিরিয়ে দেবেন। সরকারি হাসপাতালে পরিচিতকে ভর্তি করাতে হবে? বিরল গ্রুপের রক্ত দরকার? বাড়িতে বয়স্ক রোগীর দেখভাল করার জন্য কর্মঠ এবং বিশ্বাসী লোক দরকার? ধরো মদন মিত্রকে। তাঁর হাতে অনেক ‘অনুব্রতী’ আছেন। ঠিক একটা হিল্লে হয়ে যাবে। মেট্রোরেলে সমস্যায় পড়েছেন? লাগাও ফোন! সেখানেও মদনের অধীনস্থ ইউনিয়ন আছে। কত কত লোক যে মদনের আনুকূল্যে বিভিন্ন সময়ে তরে গিয়েছেন!
‘পরিবর্তন’-এর সরকারে মন্ত্রী হওয়ার পর মদনের দাপট আরও বাড়ল। সঙ্গে বাড়ল ঠাটবাট (মুখে সানস্ক্রিন লোশন, গোঁফ আরও কেয়ারি করা, চুলে গাঢ় বাদামির প্রলেপ) এবং ‘গরিবের ঈশ্বর’ হওয়ার ইচ্ছে। এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে দেওয়ার যে রাজনীতি তিনি করে এসেছেন চিরকাল, তার পরিধি আরও বাড়িয়ে নিয়ে গেলেন মদন। চারপাশে কিছু উমেদার, কিছু অর্থিপ্রার্থী, কিছু ‘সাইডকিক’-এর ভিড় বাড়ল। সংখ্যা বাড়ল মোবাইল ফোনের। যেগুলো গচ্ছিত থাকত তাঁর আমচা-চামচাদের কাছে। ফোন এলে ফোনকারীর নাম জেনে, জরিপ করে, মুড বুঝে, ভক্তিভরে জামার হাতায় স্ক্রিন মুছে তারা তুলে দিত ‘দাদা’র হাতে। কথা হয়ে গেলে আবার জিম্মা নিয়ে নিত ফোনের। গাড়ির সামনের আসন থেকে নেমে তিনি আলগোছে হাত বাড়াতেন। ম্যাজিকের মতো সেই বাড়ানো হাতে প্রায় অন্তরীক্ষ থেকে চলে আসত খুনখারাবি রঙের সানগ্লাস বা ঠান্ডা জলের বোতল। মোদ্দা কথা— দাদাকে কুটোটি নাড়তে দেওয়া যাবে না।
তাঁর কামারহাটির আস্তানায় সকাল থেকে ভিড়। তাদের মধ্যে কলেজপড়ুয়া থেকে দীন চেহারার বৃদ্ধা— কে নেই! সকলেরই কিছু না কিছু সাহায্য চাই। কোনও পড়ুয়াকে শংসাপত্র লিখে দিতে হবে তো কোনও বৃদ্ধার মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করতে হবে। একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে তিনি দরবারে হাজির। তখন থেকেই তাঁর অফিস চালু। বৃদ্ধা যে টাকা সাহায্য চাইতে এসেছিলেন, তার তিন গুণ দিলেন তিনি। নমস্কার করে বেরিয়ে যাচ্ছেন সাহায্যপ্রার্থিনী। মদন হাঁক পাড়লেন, ‘‘ও মাসিমা (মাস্সিমা— উচ্চারণে অপভ্রংশ। প্রাচীন কংগ্রেসি অভ্যাস)! সাহায্য তো নিয়ে গেলেন। নেমন্তন্ন করলেন না তো!’’
বৃদ্ধা লজ্জায় অধোবদন। গুটিগুটি পায়ে ফিরে এসে হাতজোড় করে বললেন, ‘‘আপনি কি আমার মতো গরিবের বাড়িতে যাবেন?’’
মদন: আলবাত যাব! কার্ডটা পাঠিয়ে দেবেন।
পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, গিয়েছিলেন। শুধু যানইনি, দামি উপহার দিয়ে সাঙ্গোপাঙ্গদের পাশে নিয়ে জমিয়ে খ্যাঁটনও সেরে এসেছেন।
তাঁর পুত্রের বিবাহের রিসেপশনে একাধারে আমন্ত্রিত মন্ত্রী, শীর্ষ আমলা থেকে শুরু করে গাল-কাটা, নাক-কাটা অভ্যাগতেরা। ভিতরের মঞ্চে টেলিভিশনের রিয়্যালিটি শো-খ্যাত গায়িকা সঙ্গীত পরিবেশন করছেন। আর বাইরের ফুটপাথের পাশে বাতানুকূল যন্ত্র চালু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ভলভো বাস। ভিতরে অতিথিদের জলপানের সুবন্দোবস্ত। বরকর্তা মদন মৃদু মৃদু হাসছেন। মাঝেমাঝে আলগোছে ডান হাতটা তুলছেন। বরহস্তের মতো। ভাবখানা— মেজাজটাই তো আসল রাজা।
পরিবহণ দফতরে কাজ করতে এসেছেন অনভিজ্ঞ আমলা। প্রথম দিন সকালেই ইউনিয়নের নেতা গিয়ে চমকে এসেছেন তাঁকে। কম্পিতবক্ষে নবীন আইএএস ফোন করলেন মন্ত্রীকে। মন্ত্রী ইন্টারকম তুলেই বললেন, ‘‘বলুন স্যর।’’ আমলা হতভম্ব! ‘স্যর’ বলার কথা তো তাঁর। আমতা আমতা করে ঘটনা জানালেন। মন্ত্রী বললেন, ‘‘বিকেল চারটে নাগাদ একটু সময় হবে স্যর?’’
—‘‘হবে।’’
কথামতো বিকেল চারটেয় মন্ত্রী ইউনিয়নের নেতা-সহ হাজির আমলার ঘরে। এমনিতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ অথচ তখন কেঁচোর মতো গুটিয়ে-যাওয়া নেতার থুতনি ধরে মুখটা সামান্য তুলিয়ে মন্ত্রী বললেন, ‘‘স্যরকে ভাল করে দেখে রাখ। কারণ, এই শেষ বার তোর সঙ্গে ওঁর দেখা হচ্ছে। উনি যা লেখাপড়া করে আইএএস হয়েছেন, সেটা তুই সাত-সাতটা জীবনেও করে উঠতে পারবি না। পাশ করা তো অনেক দূরের কথা। আর কোনও দিন যেন এই ঘরের ত্রিসীমানায় না দেখি!’’ ওইটুকুই। আর কোনও বাক্যবিনিময় হয়নি। হতবাক এবং বিস্মিত আমলাকে দণ্ডায়মান রেখে জোড় হাতে নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। সেই আমলা ক্রমে প্রবীণ হয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন দফতরে কাজ করেছেন। সত্যি সত্যিই সেই ইউনিয়ন নেতার সঙ্গে তাঁর আর কখনও দেখা হয়নি। বহু বছর পরেও ঘটনাটার কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলায় সম্ভ্রম এবং প্রশংসা।
দক্ষিণ কলকাতায় এক কংগ্রেস নেতার বাড়িতে তুমুল আড্ডা বসেছে। গল্পগুজারি করতে করতে রাত ভাটি। তরুণ সাংবাদিক ভাবছে, অত রাতে কী করে সল্টলেকের বাড়িতে ফিরবে। ঈষৎ টলমলে তিনি কথাটা শুনে বাঁ দিকের ভ্রু-টা খানিক উপরে তুলে বললেন, ‘‘কেন? মদন মিত্র তো বেঁচে আছে! নাকি?’’
সাদা বোলেরোর স্টিয়ারিঙে তিনি বসলেন এবং রেসকোর্সের সামনে অবলীলায় রং-সাইড দিয়ে উঠে পড়লেন এজেসি বোস রোডের উড়ালপুলে। চালকের পাশের সিটে বসে দেখছি, উল্টো দিক থেকে ভীমবেগে দৈত্যাকার সব ট্রাক ছুটে আসছে। হেডলাইটের তীব্র আলোয় চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। মদনও চোখ পিটপিট করে দেখছেন। কিন্তু তিনি শশার মতো শান্ত। কিছু ক্ষণ পরে একটা হুঙ্কার দিলেন, ‘‘বোলেরো ঘোরাও!’’ কাকে বললেন কে জানে! নিজেকেই বোধহয়। তার পর গাড়ি রিভার্স গিয়ারে ফেলে পিছু হটতে হটতে নেমে এলেন। এবং আবার ঠিকঠাক সরণি বেয়ে উঠে পড়লেন ফ্লাইওভারে। উদ্বিগ্ন সাংবাদিককে সল্টলেকের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে ফেরত গেলেন ভবানীপুরের বাড়িতে।
তূরীয় মেজাজ যাকে বলে।
যে মেজাজে তিনি কয়েক বছর পরে দেখা দেবেন নেতাজি ইন্ডোরে ক্রীড়ামন্ত্রীর দফতরে। চারদিকে রব, সারদা মামলায় যে কোনও দিন গ্রেফতার হতে পারেন মদন। সত্যি নাকি? তেমন আশঙ্কা আছে? সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে (মন্ত্রী হলেও এমন সরাসরি প্রশ্ন তাঁকেই করা যেত) হ্যা-হ্যা করে হাসলেন মদন, ‘‘করলে করবে! আরে এত দিন ধরে এত লোকের এত উপকার করেছি। জেলে গেলে কি আর হাত-পা টিপে দেওয়ার দু’একটা লোক পাব না?’’
সম্ভবত পেয়েছিলেন। তবে তা নিয়ে তাঁকে খুব বেশি সময় বিব্রত থাকতে হয়নি। প্রথম কিছু দিন সংশোধনাগারে থাকলেও বন্দিত্বের অধিকাংশ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন তাঁর রচিত ‘ঘরবাড়ি’ এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডের কেবিনে (ঘটনাচক্রে, যে হাসপাতালে রোয়াব দেখিয়ে তিনি বিপাকে পড়েছেন)। তবে দীর্ঘ কারাবাস তাঁকে ততটাও পেড়ে ফেলতে পারেনি, যতটা পেরেছিল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ঠাঁইনাড়া হয়ে যাওয়া। সেটা বোধ করি আশ্চর্যও নয়। এই সে দিনও যে তিনি গর্ব করে বলেছেন, গ্রেফতার হওয়ার পরেও দীর্ঘ দেড় বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর ইস্তফাপত্র গ্রহণ করেননি, সেই তিনিই মন্ত্রী না হওয়ার অপ্রাপ্তি সম্পর্কে আনন্দবাজার অনলাইনের ফেসবুক লাইভে কোনও রাখঢাক না-করে বলেছিলেন, ‘‘আমি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। একটা সময়ে মুঠো মুঠো অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট ট্যাবলেট খেয়েছি।’’
অবসাদ মদনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি নিজস্ব বুদ্বুদ তৈরি করে নিয়েছেন। যে জগতে তিনি একা। একমেবাদ্বিতীয়ম। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর বরফির মতো। ‘কালারফুল বয়’। সময়োপযোগী রাজনীতির লাইনে না-হেঁটে ইনস্টাগ্রামে বেভুল সমস্ত ‘রিল’ বানিয়ে, উৎকট রঙের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে কুমড়ো নিয়ে ‘ওহ্ লাভলি’ বলে নাচাগানা করে, কথায় কথায় ফেসবুক লাইভ করে, মনোহরা রমণী পরিবৃত হয়ে, ক্যামেরার সামনে চাঞ্চল্যকর এবং চটুল সব ডায়ালগ (ওগুলো ‘ডায়ালগ’ই। সংলাপ নয়) বলেছেন। তাঁকে নিয়ে তৈরি ভিডিয়োর পটভূমিকায় বাজছে সুভাষ ঘাই নির্মিত ‘রাম-লখন’ ছবির ‘ওয়ান টু কা ফোর’ গানের মুখড়ার অনুকরণে লিখিত ‘ধিনা ধিন ধা, ও মদনদা’। আর তিনি রাজকীয় হাসি হাসছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, দিব্যি আছেন। কিন্তু পোড়খাওয়া রাজনীতিক তিনিও সম্ভবত বুঝতে পারছেন, তাঁকে আর কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছে না।
মদন কি বুঝতে পারছেন যে, তাঁর রাজনৈতিক জীবন আবার টলমলে হয়ে পড়েছে? গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে আবার রং-সাইডে ঢুকে পড়েছেন তিনি? মদন কি বুঝতে পারছেন যে, একদা তিনি যে মহাকাব্যের নায়ক ছিলেন, সেই কাব্যটাই এখন তাঁর দলে উপেক্ষিত? সম্ভবত পারছেন। শুনলাম ঘনিষ্ঠদের কাছে বলেছেন, ‘‘ধুস! এখন কি আর কোনও পলিটিক্স হয়!’’ সত্যিই তিনি যে ব্র্যান্ডের রাজনীতি করতেন, এই তৃণমূল তা অনেক পিছনে ফেলে এসেছে। মদন বুঝতে পারছেন। তাই বলছেনও। বলছেন বটে। কিন্তু ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টাও করছেন। যে করে হোক। খানিক গরমে, খানিক নরমে। খানিক দলকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করে, আবার বেগতিক দেখলে খানিক ঝুঁকে পড়ে।
মদন বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, দিনকাল পাল্টে গিয়েছে। উল্টো দিক থেকে কড়া আলো জ্বালিয়ে দ্রুতগামী ট্রাক ছুটে আসছে। হুঙ্কার দেওয়ার দিন গিয়েছে। এখন শ্বাসবায়ুর শব্দে, চুপি চুপি নিজেকে আবার বলতে হবে, ‘বোলেরো ঘোরাও’! তার পরে মাথা ঠান্ডা রেখে গাড়ি রিভার্স গিয়ারে ফেলে আস্তে আস্তে পিছু হটে ঠিক রাস্তায় উঠতে হবে।
শেষ পর্যন্ত কি তিনি সফল হবেন? জানি না। তবে মদনের জন্য চিন্তা হয়। তিনি তো প্রীতি জিন্টা নয়!
(সব ছবি মদন মিত্রের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy