গুজরাটে ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
জিএসটি, নোটবন্দি, অতিমারির ত্রিফলা আক্রমণে দু’টি বড় দোকান খুইয়ে চাকা-গাড়িতে মোজা, স্কার্ফ আর ওড়না নিয়ে তিনি ফুটপাথে। অনেক কপাল চাপড়ানোর পরেও বলছেন, মোদীই জিতবেন!
বাপ-দাদার আমলের সেলুন আগলে বসে রয়েছেন। প্রাচীন দরে ভাড়া বলে টিকে আছেন। কোমর কিন্তু ভেঙে গিয়েছে। প্রশ্নের জবাবে উত্তর, নাহ্! বিজেপি-কে সরকার থেকে সরানো যাবে না!
স্নাতকোত্তর হয়ে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছেন। জানেন, সরকারি সুযোগ প্রায় নেই, বেসরকারিতে বেতনে পোষাবে না। সরকারের শাপশাপান্ত করার পরেও বক্তব্য, মোদী-শাহকে এই মাটিতে হারাবে কে! তবে আজ না হোক, পাঁচ বছর পরে কিন্তু পরিবর্তন আনবে আপ।
সৌরাষ্ট্র, কচ্ছ, দক্ষিণ গুজরাতের ৮৯টি কেন্দ্রে সকাল আটটা থেকে ভোটদানকালে সর্বত্র এই স্ববিরোধিতাটাই বাস্তব হয়ে দাঁড়াতে দেখছি। পাঁচ বছর আগে এই বলয়ে কংগ্রেস সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু সে বারে ছিল তীব্র পাটিদার হাওয়া। সদ্য জিএসটি-র ক্ষত। ছিল না ত্রিপাক্ষিক লড়াই। ভোটের তিন মাস আগে থেকে শুধুমাত্র গুজরাতে রাহুল গান্ধী জনসম্পর্ক যাত্রা শুরু করেছিলেন। এ বারে তাঁকে গুজরাতে প্রচার করতে দেখা গিয়েছে কদাচিৎ। সব মিলিয়ে ক্ষোভের চোরাস্রোত সত্ত্বেও আজ বুথমুখী জনতার অধিকাংশ প্রকাশ্যেই কমলবন্দনায়। আর যেখানে ভোট দ্বিতীয় পর্বে, সেই আমদাবাদ বিমানবন্দর থেকে ৩৮ কিলোমিটারের পুষ্পযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রথম দফার ভোটারদের ভোট দিতে যাওয়ার সময় যা এক সুকৌশল বার্তাও বটে।
রাজকোটের কেন্দ্রে প্রাচীন এক বাজার ধর্মেন্দ্র মার্কেট। শতাব্দী প্রাচীন বাড়ির সঙ্গে মিলে মিশে রয়েছে হালফিলের আইসক্রিম পার্লার। “অঙ্কেলশ্বরে আমার পাইকারি দোকান ছিল। কোটিপতি ছিলাম বলতে পারেন। আজ দেখে বুঝতে পারবেন না। রাস্তায় নেমে এসেছি।” বলছেন হীরানন্দ কমলেশ ভাগচন্দানি। একটি সাইকেল-ঠেলায় জামাকাপড়ের স্তূপ। “তিনটি দোকান ছিল এইধর্মেন্দ্র বাজারে, যার মোট ভাড়া মাসে সোয়া লাখ। তাতেও অনেকটাই লাভ থাকত। বড় শহরে থাকব বলে এই রাজকোটে এসেছিলাম। এরপর জিএসটি, নোটবন্দি, তারপর কোভিডের শেষ ঘা। এখন যা থাকে, তাতে বিজলির ভাড়া দেব না চুল্লি জ্বালাব না কি খাবার কিনব!”
আপ তো এ বার প্রচারে ঝাঁপিয়েছে রাজকোট, সৌরাষ্ট্রে। “তাতে কী হবে? মোদীকে কেউ হারাতে পারবে না এখানে। চব্বিশের আগে রাম মন্দির বানিয়ে লোকসভায় বিজেপি আসবে, আপনি লিখে রাখুন। মোদী জানেন কী ভাবে জিততে হয়। হিন্দু-মুসলমানের হিসাব ওঁর পরিষ্কার। ভিতর থেকে নিজেকে মোদী এমন শক্তিশালী করে ফেলেছেন যে কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। এই দেশটাও ক্রমশ চিনের মতোহয়ে যাবে।”
উনিশ-বিশ একই কথা রাজকোটের অনেক দোকানদারের। ‘চুনিলাল পান শপ’-এ সাজানো রয়েছে গুজরাতি, বারাণসী থেকে মঘাই — থরে বিথরে। মালিক রাজু ভাই চহ্বান বলছেন, “বিউগল তো সর্বত্র বিজেপি-রই বাজছে।” মূল্যবৃদ্ধি এবং কোভিডে তিনিও কাহিল। “গোটা দেশই তো বিজেপি কব্জা করে রেখেছে। আর গুজরাত তো অমিত শাহের নিজের ঘর। এখানের কোতোয়াল, সরকার, প্রশাসন, পুরনিগম, পঞ্চায়েত – সবটাই তো বিজেপি-র হাতে। অন্য কেউ আসবে কী ভাবে?”
মোট চারটি আসন এখানে। রাজকোটে ৬৮ থেকে ৭১। বিজেপি-র প্রতাপের পাশাপাশি চোখে পড়ছে বিজেপি-তে টিকিট না পাওয়া বিদ্রোহীদের ক্ষোভ এবং জাতপাতের অঙ্কও। তবে সবচেয়ে বড় ধাঁধা (শুধু রাজকোটে নয়, গোটা সৌরাষ্ট্রেই) রাজ্যে নবাগত অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল এই নির্বাচনে কার ভোট কাটবে বেশি? আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে অবশ্যই কংগ্রেসের। কিন্তু এই নির্বাচনী ক্ষেত্রের অন্য একটি হিসাব বলছে, বিজেপি-রও। এবং এটাও বলছে, কংগ্রেস নয়, আগামী বারের বিধানসভা অথবা চব্বিশের লোকসভায় আপ-কে নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব। কারণ, তারা রাজনীতির কথা কম বলছে, উন্নয়নের প্রশ্নে বিজেপি-র ব্যর্থতা দেখিয়ে দিল্লি-মডেলকে তুলে ধরছে।
রাজকোটের প্রবীণ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ পরেশ পাণ্ডিয়ার হিসাব, “রাজকোট ৬৮ খুবই ঐতিহাসিক আসন। নরেন্দ্র মোদী জীবনের প্রথম নির্বাচনটি (বিধানসভা) এই আসন থেকে জেতেন। ভাজুভাই ওয়ালা তারপরে এখান থেকে জিতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হন। পরে তাঁকে কর্ণাটকের রাজ্যপাল করা হয়। বিজয় রূপানি এখান থেকে জিতে এসে প্রথমে মন্ত্রী এবং পরে মুখ্যমন্ত্রী হন। এ বার পানিকে তো নয়ই, তাঁর ঘনিষ্ঠ লোহানা (বানিয়া ব্রাহ্মণ) সম্প্রদায়ের কমলেশ মীরানি এবং ব্রাহ্মণ নেতানীতীশ ভরদ্বাজকেও টিকিট দেওয়া হয়নি। টিকিট দেওয়া হয়েছে দর্শিতা বেন-কে আরএসএস-এর কথায়। দর্শিতার বাবা ছিলেন আরএসএস-এর বড় নেতা এবং অটলবিহারী বাজপেয়ীর দাঁতের ডাক্তার! এ বারই প্রথম লড়ছেন দর্শিতা।”
এই নির্বাচনী ক্ষেত্রে লাখ তিনেক ভোটারের মধ্যে ব্রাহ্মণ, লোহানি এবং মুসলিম মিলিয়ে প্রায় এক লাখের কাছাকাছি। তার মধ্যে আপ দাঁড় করিয়েছে ব্রাহ্মণ প্রার্থী। রয়েছে টিকিট না পাওয়া রূপানি গোষ্ঠীর চোরা বিক্ষোভ। একই ভাবে রাজকোটের অন্য আসনগুলিতে, জুনাগড়ে, সুরাটে আপ কোথাও ব্রাহ্মণ কোথাও পটেল প্রাথী দিয়েছে, যেখানে যেমন বিজেপি-র প্রার্থী রয়েছে তার সঙ্গে মিলিয়ে।
তবে চোরা বিক্ষোভ, টিকিট না পাওয়ার ক্ষোভ এবং আপ-প্রভাব সার্বিক ভাবে বিজেপি-র আসন সংখ্যা কিছুটা কমালেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা আটকাতে পারবে না বলেই মনে করছে শান্তিপ্রিয় রাজকোট। বাসিন্দারা বলছেন, এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল হলেও (এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই কারও), মেরুকরণের বীজ ভালই ফসল দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy