কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিস মিশ্র মনু। ফাইল চিত্র।
আখ খেতের ধারে দেহটা ছটফট করেছে অনেক ক্ষণ। হাত দুটো শূন্য আঁচড়াচ্ছিল। কোনও রহস্যময় মোবাইলে তোলা সেই ভিডিয়ো ফুটেজ আজ থেকে গ্রামে ছড়াচ্ছে।
“এমনটাই তো হয়। মানুষ মরে যাচ্ছে, তাকে না বাঁচিয়ে ভিডিয়ো তুলেছে কেউ! কে তুলেছি, কী উদ্দেশ্যে, আর কী ভাবেই তা ছড়িয়ে গেল তার সূত্র এখনও পাইনি আমরা। অবশ্য পেয়েই বা কী হবে? তরতাজা মানুষটা আর ফিরে এসে আপদে বিপদে মাথা তুলে দাঁড়াবে না গ্রামবাসীর পাশে,” বলছেন নিহত কৃষক-সাংবাদিক-শিক্ষক রমন কাশ্যপের ভাই পবন কাশ্যপ। জানালেন তাঁর ভাই রমন কাজ করতেন স্থানীয় একটি চ্যানেল। সেই সঙ্গে খেতিও সামলাতেন। পবনের কথায়, “গোটা গ্রামের অভিভাবকের মতো ছিল ও। কোনও ভয়ডর ছিল না। অন্যায় দেখলে তখনই সেটা সংবাদমাধ্যমে প্রচার করত।” জানালেন, সে দিন নিজে কোনও প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিতে নয়, বরং ‘কভার’ করতেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন রমন।
উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরি জেলার থাঠ্ঠা নানপাড়া, মাখরোনিয়া, চৌকরা ফার্ম পালিয়াকালা গ্রামগুলির অর্ধেক জুড়ে যদি থাকে শোক, বাকি অর্ধেক ফুটছে রোষে। একটাই দাবি, ‘অপরাধীদের শাস্তি চাই। যাতে আর কেউ এমন করতে সাহস না করে।’
এই ক্ষোভের আঁচ মিলল, ফোনে নিহত কৃষক পরিবারগুলির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে। “গুলি চলতে দেখেছে অনেকেই। নিজে ছিলাম না। কিন্তু চার দিন পরে দু’বার ময়নাতদন্তের পরে যখন দেহ এল, বুকে বুলেটের দাগ। আমাদের বলা হল, পথে গড়িয়ে যাওয়ার পর নাকি বুকে লোহা ঢুকে গিয়েছে!” শুধু অবিশ্বাসই নয়, কাঁচা ক্রোধ ঝরছে নিহত বিশ বছরের যুবক গুরুবিন্দ্র সিংহের মামা রঞ্জিত সিংহের কণ্ঠে। বলছেন, “আমাদের মহল্লার চেনা লোক ছিল ওই জায়গায়। যে নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেই জানায় গুরুবিন্দ্রকে গুলি করে মারা হয়েছে মন্ত্রীর গাড়ি থেকে। ওই রাস্তায় ঢোকার পরেই গুলি চালানো হয়। ময়নাতদন্তের সময় আমাদের যে লোক গিয়েছিল, তাকে পুলিশ ভিতরে যেতে দেয়নি। পর পর দু’বার ময়নাতদন্ত করানো হয়েছে চাপ দিয়ে। দু’বারই এক রিপোর্ট। আমরা দেহ পাওয়ার পর বুলেটের ক্ষত দেখেছি। সব ধামাচাপা দিচ্ছে সরকার।”
কৃষক পরিবারের পক্ষ থেকে এই গুলি চালনার অভিযোগ আজ উঠে এসেছে সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতেও। প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা গুলি চালানোর প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছেলে আশিস মিশ্র গাড়ির বাঁ দিকে বসে গুলি চালিয়েছেন বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
“যে বা যারা এগুলি করে থাকুক, খুব ঠান্ডা মাথায় আগে থেকে পরিকল্পনা করেই খুন করেছে। নয়তো ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে আসার কোনও প্রয়োজন ছিল না। ওরা যে অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিল সেখানে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে এই রাস্তায় এসেছে এটা জেনেই যে এখানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হচ্ছে চাষিদের। পুলিশও ব্যারিকেড সরিয়ে নিয়েছিল ওই খুনে গাড়ি ঢোকানোর জন্য,” বলছেন রঞ্জিত সিংহ। বাবা-মা আর দুই বোনকে নিয়ে সংসার ছিল গুরুবিন্দ্রর। পরিবারের কেউ এখনও কথা বলার অবস্থায় নেই। সব ঝাড়ঝাপটা সামলাচ্ছেন এই মামাই। জানালেন, “প্রবল ধার্মিক ছিল ও, এই অল্প বয়সেই। সাতে পাঁচে থাকত না। পারিবারিক চাষের কাজে হাত লাগাত। বাকি সময়টা নিজের মতো ধর্মগ্রন্থ পড়ে কাটাত। আজ ক্ষতিপূরণে কি ওর জীবন ফিরে আসবে?”
হাহাকার করছেন চৌকরা ফার্ম পালিয়াকালা গ্রামের সতনাম সিংহ। তাঁর সন্তান লভপ্রীতও বিশ বছর বয়সি। লখিমপুরের বেসরকারি কলেজে পড়াশুনো করে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখত সে। তৈরিও হচ্ছিল সেই ভাবেই। সেই সঙ্গে দুই বোন অমরপ্রীত আর গগনপ্রীতের বিয়ে দেওয়ার চিন্তাও ছিল এই সদ্য যুবকের। সেখানকার গ্রাম প্রধান অমরজিত সিংহ, ফোনে ধরিয়ে দিলেন সতনামকে। ভাল করে কথা বলার অবস্থায় নেই সতনাম। শুধু বললেন, “যতই টাকা আসুক, যা খুইয়েছি তা ফিরে আসবে না।” সেই সঙ্গে জানালেন— রাহুল, প্রিয়ঙ্কা পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। দেখা করেছেন অখিলেশ যাদবও।
দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত রাতে ঘুম হবে না এই সন্তপ্ত পরিবারগুলির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy