প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে, মঙ্গলবার। ছবি- রয়টার্স।
দু’জনেই চারের কথা ভাবছেন। এক জনের দ্বিতীয় মেয়াদের বাকি আর চার বছর। অন্য জনের পরবর্তী চার বছরের মেয়াদ। তাই দু’জনেই আজ-কাল-পরশুর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন।
এক জন চাইছেন, যত বেশি পরিমাণে সম্ভব মার্কিন পুঁজি টেনে এনে দেশের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে। চার বছর পর যাতে নির্বাচনী প্রচারে সেটাকে ইস্যু করা যায়।
অন্য জন চাইছেন, দ্বিতীয় বারের মেয়াদে যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় আক্ষরিক অর্থেই, ভারতকে তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু বানিয়ে ফেলতে পারেন। যাতে চিনের গলায় ‘কাঁটা’ বানিয়ে রাখা যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতকে। দক্ষিণ এশিয়ায় বেসরকারি ভাবে ভারতকে যাকে আমেরিকার একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ‘স্ট্র্যাটেজিক বেস’ করে তোলা যায়।
দু’জনেরই হাতে চার-চারটে বছর সময় আছে বলে এমনকি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এখন ভবিষ্যতের ভাবনাই বেশি ভাবতে চাইছেন, বরাবর যিনি তাৎক্ষণিক লাভালাভকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ট্রাম্পও হয়ে উঠেছেন অনেকটা ভবিষ্যবাদী!
তাই মার্কিন মুলুকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি হল কি হল না, তা নিয়ে দৃশ্যত কোনও মাথাব্যথা দেখা গেল না যথেষ্টই হিসেবি বলে সুপরিচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের।
মোদীর চিন্তা কি আপাতত কমল?
তাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কপালেও ভাঁজ বাড়ল না। কারণ, সেই চুক্তির জন্য যা আবশ্যিক ছিল, সেই ভারতের বাজারে ঢোকা মার্কিন পণ্যাদির উপর বসানো শুল্ক এখনই প্রত্যাহার করতে হল না বলে। যা আর্থিক মন্দায় হাঁসফাস করা ভারতের নাভিশ্বাস আরও বাড়াত বই কমাত না।
আরও পড়ুন- ৩০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করল ভারত-আমেরিকা
আরও পড়ুন- মোদী-ট্রাম্পের ব্যক্তিগত রসায়ন কি জোরাল করতে পারবে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক?
মোদী বরং এই স্বস্তিটুকু নিয়েই থাকতে পারলেন, আগের চেয়ে দেশে মার্কিন পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ তো তাঁর আমলেই অনেকটা বেড়েছে। আর সেটা হয়েছে মার্কিন মুলুকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জমানাতেই।
বন্ধুত্ব উত্তরোত্তর জোরদার হয়েছে।
তার জন্য হয়তো তুলনায় একটু বেশি এগলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ধর্মীয় স্বাধীনতা যে ভারতে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, সফরে এসে সেই বিতর্কিত প্রসঙ্গের ছায়াও মাড়ালেন না। হ্যাঁ, মাসখানেক আগে এ ব্যাপারে তাঁর দেশের কংগ্রেসনাল কমিটির রিপোর্টে গভীর অসন্তোষ ফুটে ওঠার পরেও। ভারতে গিয়ে সে সব নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না বলে এ বছর ভোটের প্রচারে প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সরব হতে পারে জেনেও।
ভোটের বছর বলে?...
হয়তো ভোটের বছর বলেই সেটা করলেন না ট্রাম্প। যাতে মার্কিন মুলুকে থাকা ভারতীয় ভোটারদের (যা মার্কিন জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম) ‘কুনজরে’ না পড়ে যান তিনি, পুরোপুরি ‘সুনজরে’ না থাকলেও। আমেরিকায় থাকা ভারতীয় ভোটারদের প্রধান অংশটি থাকেন মূলত যে প্রদেশগুলিতে (‘স্টেটস’), সেগুলির প্রায় সবক’টিতেই আধিপত্য ডেমোক্র্যাটদের। আমেরিকার নির্বাচনে ভোটারদের ট্রেন্ড দেখাচ্ছে, যে অনাবাসী ভারতীয়রা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেন, তাঁদের বড় অংশই ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক। সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর পাশাপাশি ভারতেরও ভূয়সী প্রশংসা করে ডেমোক্র্যাটদের সেই ভোট-ভিত্তিটা ভাঙারও চেষ্টা থাকতে পারে ট্রাম্পের।
নমস্তে ট্রাম্প। আমদাবাদে, সোমবার।
তবে সেটাই আসল কথা নয়। কারণ, এই মুহূর্তে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে জনপ্রিয়তা (বিভিন্ন মতামত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গড়ে ৪৯ শতাংশ), তাতে দ্বিতীয় বারের জন্য তাঁর হোয়াইট হাউসে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই জোরালো।
তাই ফের জিতে আসার ভাবনাটা বোধহয় অতটা ভাবাচ্ছে না এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। আর ভারতীয় ভোটারদের পাশে না পেলে বা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় পাশে না পেলে যে তাঁর সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোটা দুরূহ হবে ট্রাম্পের, তা-ও নয়।
মোদীকে বড়ই প্রয়োজন ট্রাম্পের
হোয়াইট হাউসে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী ট্রাম্প তাই ভাবতে শুরু করেছেন তাঁর পরবর্তী মেয়াদের চারটি বছর নিয়ে। সেই চার বছরে এশিয়ায় তাঁর সামরিক ও বাণিজ্যিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বে চিনের একটি নজরকাড়া শক্তিতে পরিণত হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে। ভারত সেই চিনের একেবারে পাশের ঘরের প্রতিবেশী হওয়ায় তাই আগামী চার বছরের জন্য ভারতকে বড়ই প্রয়োজন ট্রাম্পের। ভারতের জনসংখ্যা যেমন তাঁকে মার্কিন পণ্যাদির বাজার সম্প্রসারণে সাহায্য করবে, তেমনই দক্ষিণ চিন সাগরের কাছাকাছি থাকা দেশ ভারতকে যদি বেসরকারি ভাবে হলেও, আমেরিকার ‘স্ট্র্যাটেজিক বেস’ বানিয়ে ফেলা যায়, তা হলে রাতের ঘুমটা আরও ভাল হবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের।
সে জন্য বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জিতে আসা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে খুব প্রয়োজন ট্রাম্পের। আর তার জন্য তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়নটাও পাকাপোক্ত করার দরকার।
সেটা হচ্ছেও। গত বছর টেক্সাসের হিউস্টনে ট্রাম্পের সমর্থনে একটি সমাবেশে গিয়েছিলেন মোদী। সেখানে তাঁর অভ্যর্থনায় আয়োজন করা হয়েছিল ‘হাউডি মোদী’ নামক একটি ঐতিহাসিক সমাবেশ। তার পর সোমবার দু’দিনের ভারত সফরে এলেন ট্রাম্প। আমদাবাদে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভ্যর্থনায় আয়োজিত হল ‘নমস্তে ট্রাম্প’। কিন্তু এর মধ্যেও বিদেশে বিভিন্ন শীর্ষ সম্মেলন, ‘জি-২০’ জোটের বৈঠক ও রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে আরও তিন বার মুখোমুখি কথা হয়েছে ট্রাম্প ও মোদীর। তার মানে, এক বছরেরও কম সময়ে মোদী ও ট্রাম্প মুখোমুখি একান্তে কথা বলেছেন পাঁচ বার। আর কোনও বিদেশি রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বার মোলাকাত হয়নি মোদীর। ট্রাম্পেরও। ফলে, তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়নকে আরও পাকাপোক্ত করে তোলার ব্যাপারে দু’জনেই উৎসাহ দেখিয়েছেন, দেখিয়ে চলেছেন। প্রকাশ্যে।
ভারতের স্বার্থ নেই?
ভারতের প্রধানমন্ত্রীরও স্বার্থ আছে। পাশে চিন আছে, আছে পাকিস্তান। আছে আফগানিস্তান, যেখানে তালিবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে সেনা সরিয়ে নিতে চলেছে আমেরিকা। সেই তালিবানদের একটি অংশের (হাক্কানি) সঙ্গে আবার রীতিমতো দহরম মহরম আছে ইসলামাবাদের। তাই প্রতিরক্ষার জন্য আমেরিকাকে দরকার ভারতের। দরকার সর্বাধুনিক মার্কিন সমরাস্ত্রের। সেই সব অস্ত্র-প্রযুক্তিরও।
আফগানিস্তানে মোতায়েন মার্কিন সেনা।
সেই স্বার্থে তেলও আছে। ইরান থেকে তেল আনা বন্ধ করেছে দিল্লি। আমেরিকা থেকে তেল আসছে। উত্তরোত্তর তার পরিমাণ বাড়াচ্ছে ভারত। কিন্তু সেটা মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে অনেক দূর থেকে আনতে হচ্ছে বলে ভারতের খরচ বেড়েছে। বেড়ে চলেছে। আর্থিক মন্দার ভারে নুইয়ে পড়া মোদী সরকারকে সেটাও ভাবতে হচ্ছে। আমেরিকার বড় বড় তেল শিল্পপতিদের ঘাঁটি টেক্সাসেরই হিউস্টনে মোদীর গত বছর যাওয়ার সেটাও একটা কারণ।
ভারত, আমেরিকা ও ইজরায়েল
ট্রাম্পের আরও একটা স্বার্থ রয়েছে। দেশের সমরাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাতা সংস্থাগুলির স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি কংগ্রেসে খুব শক্তিশালী ইজরায়েল লবিটিকেও তাঁর সঙ্গে রাখার দরকার। এই লবি রিপাবলিকানদের মস্ত বড় ‘ফান্ড রেইজার’। রাশিয়া ও আমেরিকার পর ভারতকে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি যুদ্ধাস্ত্র বেচে, তার নাম, ইজরায়েল।
জনসঙ্ঘ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) আর হালে মোদীর হিন্দুবাদী নীতির সঙ্গে খুব মেলে বলে ইজরায়েলও মোদী সরকারের সমর্থক। ইজরায়েলের আরও কাছে আসতেই ২০১৫-য় প্যালেস্তাইন প্রশ্নে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোটাভুটিতে বিরত ছিল ভারত। আর গত বছর তো আগাগোড়া আমেরিকার বন্ধু ইজরায়েলের পক্ষেই ভোট দিয়েছে ভারত, রাষ্ট্রপুঞ্জে। মধ্যপ্রাচ্যে হালের অনিশ্চয়তার দরুন আমেরিকাও চায় ভারতের সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক আরও জোরদার হোক। তা হচ্ছেও। ইজরায়েলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর আর ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরেই তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে।
ভারত, আমেরিকা ও ইজরায়েলের মধ্যে আঁতাত নিয়ে ইদানীং সরব হতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানকে। ট্রাম্পের সফরের আগেই গত ১০ ফেব্রুয়ারি, দিল্লিতে এসে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইজরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তাই কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে কি কোনও ভূমিকা রয়েছে ইজরায়েলের? আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে আমেরিকার ভাবনায় কি তার প্রতিফলন ঘটবে?
ট্রাম্প জমানায় বেড়েছে ভাবসাব, ডলারের নিরিখে!
২০১৮-’১৯ অর্থবর্ষে আমেরিকায় ভারতের রফতানির পরিমাণ ছিল ৫২.৪ বিলিয়ন (এর বিলিয়ন মানে, ১০০ কোটি) ডলার। আর মার্কিন পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৫.৫ বিলিয়ন ডলার। তার মানে, বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৬.৯ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবর্থ ২০১৭-’১৮-য় যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২১.৩ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমেছে।
ভারত-মার্কিন যৌথ সামরিক মহড়া।
এ বার তাকানো যাক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) দিকে। ভারতে মার্কিন পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৭-’১৮-য় ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। যা ২০১৮-’১৯ অর্থবর্ষে বেড়ে হয়েছে ৩.১৩ বিলিয়ন ডলার।
ভারতে আমেরিকার শক্তি (এনার্জি) রফতানির পরিমাণ ওই একই সময়ে শূন্য থেকে বেড়ে গত বছর ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০১৭ সালে ভারত আমেরিকা থেকে অপরিশোধিত তেল কিনত ৯৬ লক্ষ ব্যারেল। সেটা ২০১৮-য় বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৮২ লক্ষ ব্যারেল।
শক্তি ক্ষেত্রের অংশীদারিও দু’দেশের মধ্যে কুশলী অংশীদারির স্তরে উন্নীত হয়েছে। যাকে বলা হয়, ‘স্ট্র্যাটেজিক এনার্জি পার্টনারশিপ (এসইপি)’। যেখানে মূলত চারটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। তেল ও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা-বৃদ্ধি, অপ্রচলিত শক্তি এবং সাসটেনেব্ল গ্রোথ।
ভারতকে কিছু যুদ্ধবিমান ও অত্যন্ত গোপনীয় সামরিক প্রযুক্তি বিক্রিরও তোড়জোড় শুরু করেছে আমেরিকা, যা এর আগে কখনও হয়নি।
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
ফাইল ছবি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy