Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
National News

দেবগৌড়ার অঙ্গুলিহেলনে সে দিন মন্ত্রিত্ব গিয়েছিল বজুভাইয়ের, কর্নাটকে এ বার উল্টে গেল পাশা

বিজেপির ঝুলিতে রয়েছে ১০৪টি আসন, কংগ্রেসের ৭৮টি আর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌডার দল  জেডি(এস)-এর ৩৮টি আসন। ভোটের আগে কংগ্রেস-জেডিএস-এর কোনও জোট ছিল না। কিন্তু গণনা শেষ হতে না হতেই কংগ্রেস জানায়, দেবগৌড়া-পুত্র কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে সমর্থন করতে তারা প্রস্তুত। জেডি(এস)-ও কংগ্রেসের প্রস্তাব মেনে নেয়। ফলে জোট তরান্বিত হয় এবং কংগ্রেস-জেডি(এস) মিলে সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৬-তে।

রাজ্যপাল বজুভাই বালা, ইয়েদুরাপ্পা এবং দেবগৌডা। নিজস্ব চিত্র।

রাজ্যপাল বজুভাই বালা, ইয়েদুরাপ্পা এবং দেবগৌডা। নিজস্ব চিত্র।

শিবাজী প্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৮ ২১:১৪
Share: Save:

একই যাত্রায় নানা ফল? নইলে গোয়ায় না, মনিপুরে না, মেঘালয়ে না, আর কর্ণাটকের বেলাতেই হ্যাঁ!

বুধবার সন্ধ্যায় রাজ্যপাল বজুভাই বালার বাজু-পার্শ্বে দাঁড়িয়ে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ইয়েদুরাপ্পা যখন সর্ব বৃহৎ দল হওয়ার সুবাদে মন্ত্রিসভা গঠনের দাবি জানাচ্ছেন আর সেই দাবি মেনে রাজ্যপালমশাই তাঁকে পনের দিনের (!) সময় দিচ্ছেন, তখন কর্ণাটকে ২২৪টি আসনের মধ্যে ভোট হয়েছে ২২২টিতে। অর্থাত্ ১১২টি আসন এই মুহূর্তে ম্যাজিক সংখ্যা। যে দল বা জোটের কাছে এই সংখ্যা থাকবে, সেই দল বা জোটই মন্ত্রিসভা গঠনের দাবিদার হবে। এবং বিজেপির হাতে ম্যাজিক সংখ্যা নেই।

বিজেপির ঝুলিতে রয়েছে ১০৪টি আসন, কংগ্রেসের ৭৮টি আর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌডার দল জেডি(এস)-এর ৩৮টি আসন। ভোটের আগে কংগ্রেস-জেডিএস-এর কোনও জোট ছিল না। কিন্তু গণনা শেষ হতে না হতেই কংগ্রেস জানায়, দেবগৌড়া-পুত্র কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে সমর্থন করতে তারা প্রস্তুত। জেডি(এস)-ও কংগ্রেসের প্রস্তাব মেনে নেয়। ফলে জোট তরান্বিত হয় এবং কংগ্রেস-জেডি(এস) মিলে সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৬-তে।

ভোটযুদ্ধে যে লড়াই পুরোপুরি জেতা যায়নি, রাজ-আশীর্বাদে (আর রেড্ডি ভাইদের টাকার ঝনঝনানির ভরসায়) সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলল বিজেপি।

আরও পড়ুন: মধ্যরাতে প্রায় বেনজির শুনানি, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সকালেই শপথ ইয়েদুরাপ্পার

মোদ্দা কথা হল, বিজেপি একক বৃহত্তম দল হলেও তাদের হাতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নেই। আর কংগ্রেস ও জেডি(এস) পিছিয়ে থাকলেও, পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলানোর পরে তারা ম্যাজিক ফিগারের চেয়েও ৪টি আসন বেশি। সেই সংখ্যায় ভর করেই মন্ত্রিসভা গঠনের দাবি পেশ করেছিলেন এইচ ডি কুমারস্বামী। সেই দাবি নস্যাৎ করে বাজুভাই বালা কি আসলে ২২ বছর আগের পুরোন আক্রোশ মেটালেন? ১৯৯৬ সালে দেবগৌড়া তখন কেন্দ্রে, ‘বাইরে থেকে’ কংগ্রেসের সমর্থনে গঠিত ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি। বজুভাই বালা তখন গুজরাতে সুরেশ মেহতার নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের একজন মন্ত্রী। এমন এক সময়ে তদানীন্তন বিজেপির বিদ্রোহী নেতা শঙ্করসিন্‌ বাঘেলার নেতৃত্বে ৪০ বিজেপি বিধায়ক মেহতা সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করে। সেই নিয়ে বিধানসভায় গরিষ্ঠতা প্রমাণের সময় সভার মধ্যেই শাসক দলের সদস্যদের মধ্যে তুমুল হাতাহাতিতে ভোটাভুটি পণ্ড হয়। তার পরে মুখ্যত দেবগৌড়ার অঙ্গুলিহেলনেই সে দিন সুরেশ মেহতা সরকারকে বরখাস্ত করে গুজরাতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের মতো মন্ত্রিত্ব হারান বজুভাই বালাও। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে আজ দেবগৌড়াপুত্র কুমারস্বামী যখন কংগ্রেসের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দোরগোড়ায়, তখন তাঁর দাবিকে অস্বীকার করে ইয়েদুরাপ্পাকে সুযোগ দিয়ে কি ব্যক্তি বজুভাই পুরোন ঝাল কিছুটা মেটালেন?

রাজনীতিতে অবশ্য ‘ব্যক্তিগত’ বিষয়ের থেকে বেশির ভাগ সময়ই ‘দলগত’ দিকটিই বড়। নতুবা, গোয়া, মণিপুর বা মেঘালয়ের রাজ্যপালের ব্যক্তিগত ইতিহাসে তো বজুভাইয়ের মতো পুরোন ‘ব্যথা’ ছিল না। এই সব জায়গায় কিন্তু কর্ণাটকের বিজেপির মতোই কংগ্রেসেরও একক গরিষ্ঠতা ছিল। তাতে কী! সে সবে কর্ণপাতই করেননি ওই সব রাজ্যের রাজ্যপাল মহোদয়রা। তাঁরা তখন একক গরিষ্ঠতার চেয়েও গুরুত্ব দিয়েছেন বিজেপির ভোট পরবর্তী জোটকে। ফলে, মেঘালয়ে মাত্র দু’টি আসন নিয়েও বিজেপির সমর্থনে অ-কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টে রাতভর কী ভাবে এগোল কর্নাটকের নাটকের অঙ্ক

প্রথম প্রশ্ন হল, সরকার গড়ার দাবি পেশ করার সময় যে কোনও উপায়ে ম্যাজিক ফিগার দেখাতে পারা বা প্রতিপক্ষ দাবিদারের চেয়ে বেশি সংখ্যা দেখাতে পারাই যদি ইদানীং কালে রাজ্যপালের ‘বিশেষ ক্ষমতা’ প্রয়োগের মাপকাঠি হয়, তবে কর্নাটকে কংগ্রেস-জেডিএস ভোট পরবর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট সে সুযোগ পেল না কেন? দ্বিতীয়ত, ভারতে চালু রাজনীতির হালহকিকত সম্পর্কে যাঁরা কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা সকলেই জানেন, এই ধরণের ক্ষেত্রে (যেখানে খাতায়-কলমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই) শপথ গ্রহণের পরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য যত বেশি দিন সময় দেওয়া হবে, চাণক্যনীতির (সাম-দান-দন্ড-ভেদ) প্রতিটি পন্থা তত বেশি করে ব্যবহৃত হবে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ গড়েপিটে নেওয়ার জন্য। ‘দান’ হবে ইয়েদুরাপ্পার কৃপাধন্য বেল্লারির অবৈধ খনি-মাফিয়া রেড্ডি ভ্রাতাদের অর্থে। জনশ্রুতি এই যে, কংগ্রেস-জেডিএস-এর বেশ কয়েকজন বিধায়কের কাছ থেকে নানা ভাবে সাহায্য (হয় ভোট দানে বিরত থাকা বা দল থেকে পদত্যাগ করা) চাওয়া হয়েছে। সেই ‘সাহায্যের’ মূল্য হিসেবে নাকি বহু কোটি টাকা প্রস্তাবিত হয়েছে।

আর চাণক্যের ‘ভেদ’ নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে লিঙ্গায়ত আর ভোক্কালিগা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে। দ্বাদশ শতকের বীরশৈব সম্প্রদায়ের জনক, ‘বাসবান্না’র অনুগামীরাই লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীর মানুষ। অত্যন্ত প্রভাবশালী (১৭% ভোটার) এই গোষ্ঠীরই প্রতিনিধি ইয়েদুরাপ্পা। বিজেপি এখন কংগ্রেস ও জেডিএস-এর লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ভুক্ত সেই সব বিধায়ককে ভাঙাতে চাইছে (অর্থের সঙ্গে এটি বাড়তি ‘ইন্সেন্টিভ’), যাঁরা একজন লিঙ্গায়তকেই মুখ্যমন্ত্রী পদে দেখতে চান।

কংগ্রেস কিন্তু এরই মধ্যে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। এই সব নিয়ে দু’সপ্তাহ পরে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, তা জানতে আর কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই প্রসঙ্গেই, একটা পুরনো প্রশ্ন অনেকের মনে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। জনগণের করের পয়সায় ব্যয় করে মহা-জাঁকজমকে পোষিত কেন্দ্রের শাসকদলের পছন্দসই একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি নির্বাচিত সরকারের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা ভোগ করবেন, এমনটা আমরা আর কতদিন মেনে নেব?

লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE