সংঘর্ষের মধ্যে দিল্লিতে জ্বলছে দোকান। ছবি: এপি।
সোমবার রাত সাড়ে ১১টা। উত্তর-পূর্ব দিল্লির যমুনা বিহারে শাহিদ সিদ্দিকির বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল উত্তেজিত জনতা। দোতলা বাড়ির একতলায় জামাকাপড়ের দোকান। প্রথমে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তার পর শাহিদের গ্যারাজে গাড়ি ও বাইকে আগুন লাগায় জনতা। স্লোগান ওঠে, ‘হিন্দুয়োঁ কা হিন্দুস্তান’, ‘জয় শ্রীরাম’। দোতলায় নিজের পরিবার, দু’মাসের সন্তানকে নিয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন শাহিদ।
এই সময় ঘটনাস্থলে হাজির হন বিজেপির স্থানীয় পুরপিতা প্রমোদ গুপ্ত। তিনিই বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ান, শাহিদের বাড়িতে আগুন লাগানো যাবে না। শাহিদরা প্রমোদের দীর্ঘদিনের পরিচিত। তাঁদের কোনও ক্ষতি হতে দেননি প্রমোদ।
সকলের অবশ্য শাহিদের মতো সৌভাগ্য হয়নি। সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সংঘর্ষে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল চার। মঙ্গলবার রাতে সংখ্যাটা তেরোয় পৌঁছেছে। আহত দেড়শোর বেশি। উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদ-মৌজপুরে সিএএ-বিরোধী ও সিএএ-পন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘিরে অশান্তি তৈরি হয়েছিল, মঙ্গলবার রাতে সেই অশান্তি পূর্ব দিল্লিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের নিচে সিএএ-বিরোধীদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। বিজেপি নেতা বি এল সন্তোষ আজ টুইট করেছেন, ‘‘জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনে এলাকা এখন পুরো খালি। আসল খেলা এ বার শুরু হল।’’ দিল্লির প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক কপিল মিশ্রও বলেছেন, ‘‘জাফরাবাদ খালি হয়ে গিয়েছে। আর একটা শাহিন বাগ হতে দিইনি।’’
ধোঁয়ার কুণ্ডলী দিল্লির গোকুলপুরী এলাকায়। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
মঙ্গলবার রাতে জাফরাবাদ, মৌজপুর, চাঁদবাগ, কারওয়াল নগরে কার্ফু জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছে দিল্লি পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েনের দাবি উঠেছিল। তবে প্রশাসন জানিয়েছে, যথেষ্ট সিআরপি নামানো হয়েছে। এখনই সেনা ডাকার দরকার নেই।
২৪ ঘণ্টা পরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না-আসায় কাঠগড়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দিল্লির আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার তাঁর মন্ত্রকেরই। গত কাল সারা দিন শাহ ব্যস্ত ছিলেন আমদাবাদে, ট্রাম্পের সফর নিয়ে। এ নিয়ে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। আজ অবশ্য ট্রাম্পের অনুষ্ঠানে শাহকে দেখা যায়নি। রাতে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন শাহ। কাল তিরুবনন্তপুরম সফরও বাতিল করেছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন দিল্লি পুলিশকে কার্যকরী ভাবে সক্রিয় করে তুলতে পারলেন না, সেই প্রশ্ন উঠছেই।
এ দিন মাঝ রাতে উপদ্রুত সীলামপুরে গিয়ে পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত ডোভাল। যা দেখে অনেকেই বলছেন, রাজধানীর এক টুকরো অংশের আইনশৃঙ্খলা সামলাতে এনএসএ-কে আসরে নামতে হচ্ছে, পুলিশি ব্যর্থতার এক চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে!
রক্তাক্ত: গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সংঘর্ষে গুরুতর জখম এক যুবককে। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ
পরিস্থিতি সামলাতে এ দিন গোটা উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে আগামী এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। দিল্লি-সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদেও ১৪৪ ধারা জারি হয়। নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয় গাজিয়াবাদ-দিল্লির সীমানায় যাতায়াতের উপর। টানা বন্ধ দু’দিন উত্তর-পূর্ব দিল্লির পাঁচটি মেট্রো স্টেশন। সংঘর্ষের ছবি না-দেখানোর পরামর্শ দেওয়া হয় বেসরকারি চ্যানেলগুলিকে।
কিন্তু অশান্তি থেমে থাকেনি। সংঘর্ষ পাথর-যুদ্ধ, গুলি, ভিড় জমিয়ে মারধর, অসংখ্য বাড়ি-দোকানে আগুন লাগানো, লুঠতরাজ— কিছুই বাকি থাকেনি। উত্তর-পূর্ব দিল্লির আকাশে সারা দিনই কালো ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে। আগুন নেভাতে গিয়ে দমকল কর্মীরাই আক্রান্ত হয়েছেন।
আরও পড়ুন: অশান্ত দিল্লিতে সেনা নামানো নিয়ে প্রশ্ন, শাহের সঙ্গে বৈঠক কেজরীর
উত্তর-পূর্ব দিল্লির গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে গুরুতর আহতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে মৃত্যুও বাড়ার আশঙ্কা। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আহতদের প্রায় অর্ধেক গুলিবিদ্ধ। সোমবার দিল্লি পুলিশের কনস্টেবল রতন লালের মৃত্যু হয়। প্রথমে জানা গিয়েছিল, মাথায় পাথরের চোট লেগে মার যান রতন। আজ ময়নাতদন্তে জানা গিয়েছে, তাঁর বাম কাঁধ দিয়ে গুলি ঢোকে। ডান কাঁধ থেকে সেই গুলি উদ্ধার হয়েছে।
ধৃত বন্দুকবাজ
পিস্তল উঁচিয়ে। ছবি: পিটিআই।
• সোমবার দিল্লির জাফরাবাদে সংঘর্ষের সময়ে প্রকাশ্যে গুলি চালাতে দেখা যায় শাহরুখকে (৩৩)।
• শাহদরার বাসিন্দা।
• ভাইরাল ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, পিস্তল উঁচিয়ে তেড়ে যাচ্ছে সে। সামনে এক নিরস্ত্র পুলিশকর্মী। আতঙ্কে ছুটোছুটি করতে থাকে জনতা।
• আট রাউন্ড গুলি ছোড়ে সে।
• তার বিরুদ্ধে সোমবার অস্ত্র আইনে মামলা করে পুলিশ। গ্রেফতার রাতে।
ডিসি (শাহদরা) অমিত শর্মাও বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি। হিংস্র জনতা তাঁর উপরে লাঠি নিয়ে চড়াও হয়েছিল। তাঁর মাথার খুলিতে চোট লেগেছে। পুলিশ বাহিনীর অন্তত ৫০ জন আহত। ছাড় পাননি সাংবাদিকরাও। হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, এটা ‘হিন্দুয়োঁ কি লড়াই’। অতএব ছবি-ভিডিয়ো তোলা যাবে না। তিন সাংবাদিক মারের চোটে হাসপাতালে ভর্তি।
রাজধানীর প্রবীণরা বলছেন, ১৯৮৪-র শিখ-বিরোধী দাঙ্গার পরে শহরে গোষ্ঠী সংঘর্ষে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। বছর পাঁচেক আগেও পূর্ব দিল্লির ত্রিলোকপুরীতে গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়েছিল। কিন্তু কোনও প্রাণহানি ঘটেনি।
সিএএ-বিরোধীদের সম্পর্কে রবিবারই উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছিলেন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র। প্রশ্ন উঠেছে, তিন দিন কাটতে চললেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? পূর্ব দিল্লির বিজেপি সাংসদ গৌতম গম্ভীরই কপিলের বিরুদ্ধে পুলিশি পদক্ষেপের দাবি তুলেছেন।
দিল্লি পুলিশের মুখপাত্র মনদীপ রণধাওয়া এ দিন বলেন, ‘‘ওই বিবৃতি নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু আমাদের অগ্রাধিকার হল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা।’’ কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ, কপিল পুলিশের সামনেই প্ররোচনামূলক কথা বলেছিলেন। এখনও পুলিশকে ঢাল করেই সিএএ-বিরোধীদের উপরে হামলা হচ্ছে।
সোমবার রাতে অনেকেই আশা করেছিলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। সকালে উত্তর-পূর্ব দিল্লির স্পর্শকাতর এলাকায় র্যাফ, সিআরপিএফ টহল দেয়। ব্রিজপুরীতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা একসঙ্গে শান্তি মিছিল বের করেন। অনেক এলাকায় মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বারা থেকে একসঙ্গে শান্তির আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু অশান্তি থামানো যায়নি। সোমবার রাতে গোকুলপুরীর কর্দমপুরী টায়ার বাজারের একাংশে আগুন লাগানো হয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে ফের সেখানে আগুন ধরানো হয়।
জাফরাবাদের এক বাসিন্দা ফোনে বলেন, ‘‘যে সব এলাকায় দুই ধর্মের মানুষেরই বাস, সেখানে পরিস্থিতি খুবই স্পর্শকাতর। এত দিনের বিশ্বাসে চিড় ধরে গিয়েছে। হামলার সময়ে পুলিশের দেখা মিলছে না।’’
রতন লালের শেষ যাত্রায় দিল্লির পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়ক (ডান দিকে) এবং অন্য অফিসারেরা। ছবি: পিটিআই।
শাহিন বাগের বিক্ষোভকারীদের নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছিলই। মঙ্গলবার প্রাক্তন মুখ্য তথ্য কমিশনার ওয়াজাত হাবিবুল্লা আদালতে আর্জি জানান, দিল্লি পুলিশকে এই অশান্তিরও তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হোক। সুপ্রিম কোর্ট বুধবার শুনানিতে রাজি হয়েছে। বিশেষ তদন্তকারী দল গড়ে তদন্তের দাবিতে মামলা দায়ের হয়েছে দিল্লি হাইকোর্টে। তারও শুনানি বুধবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy