Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Delhi Violence

কারা হামলা চালিয়েছে? কারা মার খেয়েছে? অভিযোগ কত? প্রশ্ন অনেক, উত্তর নেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বয়ানে

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যুক্তি দিয়েছেন, উত্তর-পূর্ব দিল্লি সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশ সীমানা পেরিয়ে সেই রাজ্যের লোক দিল্লিতে ঢুকেছিল। সংঘর্ষ শুরুর পরেই দুই রাজ্যের সীমানায় পুলিশ প্রহরা বসানো হয়। 

দিল্লি হিংসায় পুড়ে খাক সমস্ত সঞ্চয়। সেই আধপোড়া টাকা হাতে অসহায় মুর্শিদা। বৃহস্পতিবার শিব বিহারে। পিটিআই

দিল্লি হিংসায় পুড়ে খাক সমস্ত সঞ্চয়। সেই আধপোড়া টাকা হাতে অসহায় মুর্শিদা। বৃহস্পতিবার শিব বিহারে। পিটিআই

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২০ ০৩:৪৭
Share: Save:

দিনটা বৃহস্পতিবার। তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি। ভরদুপুরে শিব বিহার ও মুস্তফাবাদের মাঝের রাস্তায় দিল্লি পুলিশ ও সিআরপি-র র‌্যাফের বিশাল বাহিনী। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সাংবাদিকের ভিড়। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছিল, শিব বিহারের পাঁচ নম্বর গলিতে আউলিয়া মসজিদের ভিতর থেকে কালো ধোঁয়া উঠছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতেই সম্ভবত আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই মসজিদে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পাথর-লড়াই।

সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন, দিল্লির হিংসার ঘটনায় ২৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ২টোয় প্রথম অভিযোগ এসেছিল। শেষ অভিযোগ আসে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায়।

তা হলে বুধবার রাতে শিব বিহারের ধর্মীয় স্থানে হামলার ঘটনার কি কোনও অভিযোগই জমা পড়েনি?

রাজ্যসভায় দিল্লির হিংসা নিয়ে আলোচনায় কংগ্রেসের কপিল সিব্বলও বলেছেন, ২৬ ফেব্রুয়ারি কারওয়াল নগরে দু’জনের রাস্তা আটকে পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তার পরে তাঁদের পোশাক খোলানো হয় এবং খুন করা হয়। সেই ঘটনার কোনও অভিযোগই কি জমা পড়েনি পুলিশের কাছে? মন্ত্রী কী ভাবে বলছেন যে, ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতের পরে আর কিছু ঘটেনি?

দিল্লির হিংসা নিয়ে দেশ জুড়ে প্রশ্ন— কারা হামলা চালিয়েছে? কারা মার খেয়েছে? সংসদে বিতর্কে দিল্লির সাংসদ মীনাক্ষী লেখি-র মতো বিজেপির নেতানেত্রীরা দাবি করেছেন, সংখ্যাগুরুরাই চুপ করে মার খেয়েছেন। হামলা চালিয়েছে সংখ্যালঘুরা। কোনটা সত্যি?

সম্বল: পুড়ে খাক বাড়িতে খেলায় ব্যস্ত খুদে। উত্তর-পূর্ব দিল্লির খাজুরি খাসে। বৃহস্পতিবার। পিটিআই

সোমবার দুপুরে জাফরাবাদের মেট্রো স্টেশনের তলায় সংঘর্ষের প্রথম ঘটনা থেকে শুরু করে সপ্তাহান্ত পর্যন্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার পরে আনন্দবাজারের সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা বলছে, এক কথায় এর স্পষ্ট উত্তর দেওয়া কঠিন। যে-সব এলাকায় শুধু হিন্দুদের বাস, সেখানে কার্যত কোনও হামলা হয়নি। পুরোপুরি মুসলিম মহল্লাতেও কোনও হামলা হয়নি। যেখানে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে থাকতেন, সেখানেই হয়েছে গন্ডগোল। যেমন শিব বিহার ও মুস্তফাবাদ। যেখানে যাঁদের সংখ্যার জোর কম, সেখানে তাঁরা মার খেয়েছেন। ১০০ ঘর সংখ্যাগুরুর পাড়ায় ১০ ঘর সংখ্যালঘু থাকলে তাঁদের বাড়িতে হামলা হয়েছে, লুঠতরাজ চলেছে, আগুন লাগানো হয়েছে। আবার ১০০ ঘর সংখ্যালঘুর পাড়ায় ১০-২০ ঘর সংখ্যাগুরু বাস করলে তাঁরা মার খেয়েছেন। এর মধ্যেই কিছু মহল্লায় এক সম্প্রদায়ের মানুষ রুখে দাঁড়িয়ে আর এক সম্প্রদায়ের মানুষকে রক্ষা করেছেন। এক সম্প্রদায়ের মানুষ আর এক সম্প্রদায়কে তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন।

বিজেপি সাংসদদের অভিযোগ ছিল, সংখ্যালঘুদের বাড়ি বা স্কুলের ছাদে ইট ছোড়ার জন্য লোহার বড় গুলতি বসানো হয়েছিল। বাড়ির ছাদে জমা করা হয়েছিল পেট্রল বোমা, অ্যাসিড। লেখি নাম করে করে বলেছেন, ফয়জল ফারুকের রাজধানী স্কুল থেকে হামলা চালানো হয়েছে। আর ভাঙচুর হয়েছে অরুণ মডার্ন পাবলিক স্কুলে।

কিন্তু নিজের চোখে ওই এলাকা দেখার অভিজ্ঞতা সে-কথা বলছে না। ফয়জলের রাজধানী পাবলিক স্কুল জুড়েও ভাঙচুর চালানো হয়েছিল। দু’পক্ষেরই দাবি, অন্য সম্প্রদায় আগে হামলা শুরু করেছে। কিন্তু তার পরে যে কেউই ছেড়ে কথা বলেনি, উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিধ্বস্ত চেহারাই তার প্রমাণ। এক পক্ষ হামলার আগাম পরিকল্পনা করে রাখলে, অন্য পক্ষ তা ঠেকানোর জন্য পুরো প্রস্তুত হয়েই ছিল।

প্রশ্ন উঠছে, সোমবার বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ যখন জাফরাবাদের মেট্রো স্টেশনের তলায় প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয়, তখন কাদের দিক থেকে প্রথম হামলা হয়েছিল? সিএএ-পন্থী না সিএএ-বিরোধীদের দিক থেকে? তদন্ত করছে পুলিশ।

কিন্তু রবিবার রাতে দুই গোষ্ঠীর অবস্থানের মাঝখানে দুই ট্রাক ভর্তি ইটপাথর কারা ফেলে গেল? এখনও উত্তর মেলেনি। মেট্রো লাইনের তলায় জাফরাবাদ মেন রোডে ইটপাথর তো অনেক খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। সেখান থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব দিল্লির অধিকাংশ রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পায়ে পায়ে পাথর। মনে হচ্ছিল, যেন নতুন রাস্তা তৈরির জন্য ইটপাথর ছড়ানো হয়েছে। এত ইটপাথর কোথা থেকে এসেছিল? পুলিশের নজর এড়িয়ে তা আসা সম্ভব? এটাও তো ঘটনা যে, সেই রবিবার এলাকায় গিয়ে সিএএ-র পক্ষে অবস্থান শুরু করান বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র। সিএএ-বিরোধী অবস্থান তুলে রাস্তা ফাঁকা করানোর হুমকি দিয়ে যিনি বলেছিলেন, আর একটা শাহিন বাগ হতে দেব না।

দিল্লির হিংসা নিয়ে দেশের মানুষের আরও একটি প্রশ্ন, কোন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রাণ বেশি গিয়েছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ যুক্তি দিয়েছেন, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁরা সকলেই ভারতীয়। ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করা উচিত নয়।

যদিও তাঁর দলের সাংসদ মীনাক্ষী বিবৃতিতে দাবি করেছেন, মার খেয়েছেন সংখ্যাগুরুরাই।

বিরোধী সাংসদেরা কিন্তু পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলছেন, ৫৩ জন নিহতের মধ্যে দু’জন পুলিশকর্মীকে বাদ দিলে বাকিদের মধ্যে ৪০ জন মুসলিম। ১১ জন হিন্দু। উত্তর-পূর্ব দিল্লির জনগণনা অনুযায়ী সেখানে ৬৮ শতাংশ হিন্দু, ২৯ শতাংশ মুসলিম।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যুক্তি দিয়েছেন, উত্তর-পূর্ব দিল্লি সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশ সীমানা পেরিয়ে সেই রাজ্যের লোক দিল্লিতে ঢুকেছিল। সংঘর্ষ শুরুর পরেই দুই রাজ্যের সীমানায় পুলিশ প্রহরা বসানো হয়।

উত্তর-পূর্ব দিল্লির গায়েই উত্তরপ্রদেশের লোনি। এটা ঠিকই যে, লোনি থেকে দিল্লিতে ঢোকার মুখে প্রায় সব রাস্তাতেই পুলিশের ব্যারিকেড ছিল। কিন্তু সেটা ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষের পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি, দিল্লি পুলিশ সক্রিয় হয়ে ওঠার পর থেকে। সে-দিন লোনিতে গিয়েও স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে শোনা গিয়েছে, দিন কয়েক আগেই ম্যাটাডর ভ্যান ভর্তি করে লোক উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ঢুকেছিল। পুলিশ টের পায়নি? স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, হিংসা যে হতে চলেছে, তার আঁচ এলাকার মানুষ পেয়েছিলেন। পুলিশবাহিনীর স্থানীয় গোয়েন্দারাও পেয়েছিলেন। পুলিশের কাছে ‘ইন্টেলিজেন্স অ্যালার্ট’-ও যায়। তা হলে আগে থেকে যথেষ্ট পুলিশবাহিনী মোতায়েন বা ধরপাকড় হয়নি কেন?

উত্তর মেলেনি।

মৌজপুর-বাবরপুর চক বা ভজনপুরায় দোকানে আগুন লাগিয়ে বা রাস্তায় পাঁচ যুবককে ফেলে পেটানোর সময় কারা বলেছিল, ‘‘নাগরিকত্ব চাই? এই নে নাগরিকত্ব!’’ বলেছিল, ‘‘বড় বাড় বেড়েছিস, আর একটা গুজরাত করতে হবে।’’

কেন বলেছিল? সংসদে শাহ বা মীনাক্ষীর বক্তব্যে তার উত্তর ছিল না।

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi Violence CAA Protest Amit Shah Death BJP heamd2
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy