আম আদমি পার্টির সদর দফতরে প্রশান্ত কিশোর ও অরবিন্দ কেজরীবাল। ছবি: পিটিআই
সামান্য হলেও টাল খেয়েছিল আত্মবিশ্বাস। বিজলি, পানি, মহল্লা ক্লিনিক, ফ্রি বাস রাইড, সিসিটিভি কভারেজ, স্কুল বিকাশের কাহিনি হঠাৎই যেন ভুলে গিয়েছিলেন। শাহিন বাগ বিতর্কে বিজেপি-কে জবাব দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলেন ভোট প্রচারের শেষ দিকটায়। কিন্তু, দ্রুত সামলেও নিলেন। কেউ সম্ভবত পিছন থেকে টেনে ধরলেন অরবিন্দ কেজরীবালকে। গেরুয়া মাঠে পা রাখার ভুলটা ভুলেও করবেন না— কে যেন মনে করিয়ে দিলেন। ফলে দ্রুত সেই মাঠে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, যেখানে তিনি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু পিছন থেকে টেনে ধরলেনটা কে? প্রশান্ত কিশোর (পিকে)? চর্চা এখন এই প্রশ্ন ঘিরেই।
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের পৌনে দু’মাস আগে পিকে-র হাত ধরেছিলেন কেজরী। ভোট হয়েছে ২০২০-র ৮ ফেব্রুয়ারি। আর ২০১৯-এর ১৪ ডিসেম্বর টুইটারে কেজরীবাল জানিয়েছিলেন যে, ‘ইন্ডিয়ানপ্যাক’ অর্থাৎ পিকের সংস্থার সঙ্গে তাঁর দল গাঁটছড়া বেঁধেছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াটা কিন্তু খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। আপ সূত্রে খবর, এই ঘোষণার মাত্র দিন পনেরো আগেই পিকের সাহায্য নেওয়ার কথাটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন কেজরীরা। কারণ ওই দিন পনেরো আগেই পশ্চিমবঙ্গে চমকে দেওয়া সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিলেন পিকে।
২০১৯-র সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় অভূতপূর্ব ফল করে বিজেপি। ১৮টা লোকসভা আসন জিতে বাংলার শাসক দল তৃণমূলকে টালমাটাল পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় গেরুয়া শিবির। কিন্তু যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল না ছাড়ার ঘরানায় অভ্যস্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভা ভোটে ধাক্কা খেয়েই পিকের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। বাংলার ৩টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনের জন্য রণকৌশল তৈরি এবং প্রচার সাজানোর ভার তিনি ছেড়ে দেন পিকের উপরেই। উপনির্বাচনের ফলাফলে চমকে দেয় তৃণমূল। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের খাসতালুক খড়্গপুর সদর এবং লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে ৫৫ হাজারেরও বেশি ভোটে লিড দেওয়া কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের কোনও ‘চান্সই’ নেই— এই রকম একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক শিবিরে। করিমপুরেও তৃণমূলকে কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়তে হবে— এমনও বলছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু ভোটের ফল উল্টো কথা বলল। করিমপুর তো বটেই, দলের ২২ বছরের ইতিহাসে যে দুই আসন কখনও জেতেনি তৃণমূল, সেই খড়্গপুর সদর এবং কালিয়াগঞ্জেও ঘাসফুলের পতাকা উড়ল। প্রশান্ত কিশোরকে কৃতিত্বের ভাগ না দিয়ে উপায় কি?
আরও পড়ুন: লাইভ আপডেট: প্রবল উচ্ছ্বাসের মধ্যে আপ-দফতরে কেজরীবাল
ভোটগণনার আগে কেজরীবালের সমর্থনে আপ সমর্থকরা। ছবি: পিটিআই।
পিকের এই সাফল্য চোখ এড়ায়নি দিল্লিতে বসে থাকা কেজরীবালদেরও। তার আগেও পিকের একাধিক সাফল্যের নজির রয়েছে। গুজরাতে বিজেপি-র হয়ে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদীর হয়ে, ২০১৫ সালে বিহারের ভোটে নীতীশের হয়ে— বার বার সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন পিকে। কিন্তু মমতার রাজ্যে পিকের সাফল্য কেজরীবালের সামনে আশার আলো আরও উজ্জ্বল করে তোলে। কারণ লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতার মতো তিনিও বিজেপি বিরোধী রাজনীতির অন্যতম মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন। আর লোকসভা নির্বাচনে তাঁর মতো সাফ না হয়ে গেলেও ধাক্কাটা মমতাও বড়সড় খেয়েছিলেন বিজেপির কাছে। সেই মমতার রাজ্যে যখন পিকে সাফল্য পেয়েছেন বিজেপির বিরুদ্ধে, তখন তাঁর রাজ্যেও পাবেন— বিশ্বাস করতে শুরু করেন কেজরীবাল। আর বাংলায় ৩ বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার দিন পনেরোর মধ্যেই ‘ডিল’ চূড়ান্ত করে ফেলেন পিকের সঙ্গে।
Thank you Delhi for standing up to protect the soul of India!
— Prashant Kishor (@PrashantKishor) February 11, 2020
‘আপ’-এর জয় নিশ্চিত হতেই টুইট করলেন প্রশান্ত কিশোর।
দিল্লি সূত্রের খবর, পরবর্তী দেড় থেকে পৌনে দু’মাসে কেজরীবালকে পথটা কিন্তু পুরোপুরিই দেখালেন প্রশান্ত কিশোর। লোকসভা ভোটে যে তারে বাঁধা ছিল অরবিন্দ কেজরীবালের প্রচার, বিধানসভা নির্বাচনে আপ-কে তার ধারেকাছে ঘেঁষতে দেননি পিকে। মোদী-শাহকে তীব্র আক্রমণ করা, পুলওয়ামার জঙ্গি হামলার নেপথ্যে মোদী সরকারের হাত থাকার ইঙ্গিত দেওয়া, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রমাণ চাওয়া, এয়ার স্ট্রাইক ও তার পাল্টা হানার পরে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দেওয়া ভাষণের প্রশংসা করা— এ সব যে দিল্লিবাসী খুব ভাল ভাবে নেননি, রাজধানীর সাত লোকসভা আসনেই বিজেপির বিপুল জয়ে তার প্রমাণ মিলেছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশের মত।
আরও পড়ুন: দিল্লি থেকে নজর ঘোরাতেই কি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি?
সেই বিশ্লেষণ মাথায় রেখেই ছক সাজাতে শুরু করেন পিকে। ফলে দিল্লিতে প্রচার শুরু হতেই দেখা যায়, লোকসভা ভোটের আগের কেজরীবাল আর বিধানসভা ভোটের আগের কেজরীবালে আকাশ-পাতাল ফারাক। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে যেন মাথাব্যথাই নেই এই নতুন কেজরীবালের। তাঁর এবং তাঁর দলের অন্য নেতাদের ভাষণ এবং আপের যাবতীয় প্রচার শুধু দিল্লি-কেন্দ্রিক। গত পাঁচ বছরে আপ কী কী করেছে দিল্লির জন্য, শুধুমাত্র তার ফিরিস্তি। বিজেপি কেন সমালোচনা করছে, বিজেপি পরিচালিত দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন কি দিল্লির জন্য উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পেরেছে? এই প্রশ্ন তোলা। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, যেন দিল্লির মেয়র হিসেবে ভোটে লড়তে নামা। আর বিজেপির মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ দল কী ভাবে সব বিজেপিশাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এবং শ’দুয়েক সাংসদকে দিল্লির ময়দানে নামিয়ে দিয়েছে, তাঁর মতো এক জন ‘ছোটা আদমি’কে হারানোর জন্য, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের গোটা প্রচার পর্বটাতেই কেজরীবাল নিজেকে এবং দলকে সীমাবদ্ধ রাখলেন শুধু এইটুকুর মধ্যে। ফলে ভোট মেটার সঙ্গে সঙ্গে সব সমীক্ষকের এক্সিট পোল জানাল, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে অনেক বেশি আসন নিয়েই ফের ফিরছেন কেজরীবাল।
২০১৫-য় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেছিলেন কেজরী। কিন্তু তার পর থেকে এ পর্যন্ত দিল্লির প্রায় সব নির্বাচনেই (পুরসভা এবং লোকসভা) জিতেছে বিজেপি। এ হেন বিজেপি-কে এ বার কী ভাবে রোখা যাবে? এই প্রশ্ন কিন্তু খুব ছোটখাটো প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের ভুলটা দ্রুত বুঝতে পারা এবং সে ভুল শুধরে নিতে পারা— এই দুই-ই সম্ভবত ভোট মেটার পরে হাসির রেখা চওড়া করে দিল অরবিন্দ কেজরীবালের মুখমণ্ডলে।
দিল্লির রায় প্রকাশ্যে আসার পরে প্রশান্তি পিকের শিবিরেও। এ দিন পিকে টুইটারে লিখেছেন, ‘‘ভারতের আত্মাকে রক্ষা করার জন্য দিল্লিকে ধন্যবাদ!’’
তবে পিকের সাজানো ছক শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা কিন্তু সহজ ছিল না মোটেই। বরং ছক ভেঙে যাওয়ার উপক্রমই হয়েছিল। কারণ শাহিন বাগে যে ভাবে লাগাতার রাস্তা আটকে সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ চলছে, তা নিয়ে সুর তুঙ্গে তুলে দেয় বিজেপি। কেজরীবালরাই শাহিন বাগের নেপথ্যে রয়েছেন বলে অভিযোগ তুলতে শুরু করে। শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির স্বার্থে কেজরীবালরা শাহিন বাগকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছেন, আপ বিধায়ক আমানতুল্লা খানই ওই বিক্ষোভের মূল উদ্যোক্তা— অভিযোগ করে বিজেপি। দিল্লিতে বিজেপি হারলে রাজধানীর সব প্রান্তে একটা করে শাহিন বাগ তৈরি হয়ে যাবে বলে বিজেপি নেতৃত্ব আশঙ্কা প্রকাশ করতে শুরু করেন। দিল্লিতে বিজেপি হারলে হিন্দুদের ঘরে ঘরে হামলা হতে পারে— আশঙ্কার সুরে এ কথাও বলে দেন বিজেপি সাংসদ প্রবেশ বর্মা। সিএএ এবং এনআরসি-কেই ভোটের কেন্দ্রীয় ইস্যু করে তোলার চেষ্টা হয় বিজেপির তরফে।
আরও পড়ুন: গণনা শুরুর সময়েও ৫৫-র আশায় ছিল বিজেপি
ভোটপ্রচারে অরবিন্দ কেজরীবাল।
সে সব কথায় প্রথম দিকে খুব একটা কান দেননি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। কারণ সম্ভবত শুধু পিকের কথাতেই তিনি কান দিচ্ছিলেন। তাই দিল্লিতে সরকারি স্কুলের চেহারা কী ভাবে তিনি বদলে দিয়েছেন পাঁচ বছরে, কী ভাবে নিখরচায় পানীয় জল সরবরাহ করা শুরু করেছেন, ২০০ ইউনিট করে বিদ্যুৎ সরকার বিনামূল্যে দেওয়া শুরু করার পর থেকে কী ভাবে হাজার হাজার পরিবারকে আর বিদ্যুতের বিলই দিতে হচ্ছে না, কী ভাবে মহল্লা ক্লিনিকে নিখরচায় চিকিৎসা এবং ওষুধ মিলছে, সরকারি বাসে মহিলাদের নিখরচায় সফরের সুবিধা দেওয়ার ফলে কত জন উপকৃত হয়েছেন, বাসে মার্শাল নিয়োগ করে এবং রাজধানীর পাড়ায় পাড়ায় সিসিটিভি লাগিয়ে কী ভাবে মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন— দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শুধু এ সবই বলছিলেন।
কিন্তু শাহিন বাগে রাস্তা আটকে থাকা নিয়ে দিল্লিবাসীদের একাংশের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছিল। বিজেপি সেই ক্ষোভকে কাজে লাগানোর চেষ্টা তো করছিলই। বিজেপির প্রচার ক্রমশ মেরুকরণের দিকেও মোড় নিচ্ছিল। ফলে জানুয়ারির শেষ দিকটায় পৌঁছে কেজরীবালকে বিচলিত হয়ে পড়তেও দেখা যায়। শাহিন বাগ নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হন তিনি। শাহিন বাগে তিনি যে এক বারও যাননি, সে কথা তাঁকে জোর গলায় বলতে হয়। মেরুকরণের চেষ্টায় বিজেপি-ই শাহিন বাগকে জিইয়ে রেখেছে বলে কেজরীকে পাল্টা অভিযোগ তুলতে হয়।
এই পথ কিন্তু কেজরীবালের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। উন্নয়ন এবং সরকারি পরিষেবার ইস্যু থেকে নজর ঘুরে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সিএএ, এনআরসি, শাহিন বাগ-ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠার উপক্রম হয়েছিল। যেটা বিজেপি শুরু থেকেই চাইছিল।
রাজধানীর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ঠিক সময়ে আবার রাশটা টেনে ধরেছেন প্রশান্ত কিশোরই। বিজেপি যা খুশি বলুক, শাহিন বাগ বা সিএএ প্রসঙ্গ নিয়ে কোনও তর্কে জড়ানো চলবে না— কেজরীবালকে এই বার্তা স্পষ্ট ভাবে দিয়ে দেওয়া হয় টিম পিকের তরফে। কেজরীর মাঠে এসে বিজেপি খেলুক, বিজেপির মাঠে গিয়ে কেজরী যেন না খেলেন— এই কথা পিকে ফের মনে করিয়ে দেন বলে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই কেজরীবাল যেন সম্বিৎ ফিরে পান। মোদী-শাহকে-মনোজ তিওয়ারিদের আক্রমণ করবেন, কিন্তু নিজের তৈরি করা ইস্যুর বাইরে অন্য কোনও বিষয়ে কথা বলবেন না— কেজরীবাল যেন আবার ফিরে যান সেই সংকল্পেই।
সব ভাল, যার শেষ ভাল। বিজেপির কট্টর লাইনের সামনে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, কিছুটা দিকভ্রষ্টও হচ্ছিলেন কেজরীবাল ঠিকই। কিন্তু ভাল কোচিং-এ হোক বা দ্রুত ভুল শুধরে নেওয়ার সক্ষমতার কারণে, পিকের ছকে দেওয়া নকশা অনুযায়ীই কিন্তু প্রচার পর্বটা শেষ করেছেন কেজরীবাল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খেলা আটকে রাখলেন নিজের মাঠেই। বিজেপির ফাঁদে পা দিলেন না কিছুতেই, গেরুয়া মাঠে খেলতে গেলেনই না। ঘরের মাঠে খেলা ধরে রেখেই আবার বাজিমাৎ করলেন কেজরীবাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy