ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ার পর থেকেই ধ্বংসলীলার যে রকম ছবি সামনে আসতে শুরু করল, তা ভয়ঙ্কর। যে পথে এবং যে গতিতে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের দিকে এগোচ্ছে ঝড়টা, তাতে উদ্বেগে থাকতেই হচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি কোনও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি নয়। বার বার আমরা এর মুখোমুখি হয়েছি। ভবিষ্যতেও বার বারই এর মুখোমুখি হতে হবে। কারণ পৃথিবীর যে অঞ্চলে আমরা থাকি, সেখানে পাশাপাশি অবস্থান করছে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত প্রবণতা। বার বার ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের মুখে পড়া এই অঞ্চলের ভবিতব্য।
এক দিকে মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ স্থলভাগ। আর তার পাশেই বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলভাগ। বিপরীত প্রবণতার উৎস এটাই।
মধ্য ভারতের প্রশস্ত স্থলভাগে প্রায় সারা বছরই সূর্যরশ্মি দাপট দেখায়। সূর্যের তাপে ওই বিস্তীর্ণ স্থলভাগের হাওয়া গরম হয়ে উপরে উঠে যায় এবং মধ্য ভারতের স্থলভাগে নিম্নচাপ অঞ্চল তৈরি হয়।
আরও পড়ুন, ‘চোখের সামনে জানলার কাচটা ভেঙে পড়ল, বাইরেটা কল্পনারও অতীত’
সেই বিশাল স্থলভাগ যেখানে শেষ হচ্ছে, ঠিক সেখানেই আবার বিশাল জলভাগ— বঙ্গোপসাগর। সূর্যের তাপে রোজ বঙ্গোপসাগরের জল বাষ্পীভূত হয়ে প্রচুর বাষ্পের জন্ম দেয়। জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ হাওয়া ভারী হওয়ায় খুব উপরে উঠতে পারে না, ফলে উচ্চচাপের পরিস্থিতি থাকে এই অঞ্চলে।
Fani cyclone live from puri pic.twitter.com/CSZayKCB8K
— AMRENDRA KUMAR (@AMR1987KUMAR) May 3, 2019
হাওয়া সব সময়েই উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। তাই বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেওয়া ভারী তথা অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা বাতাস উত্তর ভারতের স্থলভাগের দিকে ছুটে যায়। এই প্রবণতাই ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের জন্ম দেয়। তবে হাওয়া বঙ্গোপসাগর থেকে মধ্য ভারতের দিকে যেতে চাইলেই যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হবে, তেমন নয়। সমুদ্রের উপরে জমতে থাকা জলীয় বাষ্প বা ভারী বাতাস ঘূর্ণাবর্তের রূপ নেবে কি না, তা তাপমাত্রার বাড়া-কমার উপরে অনেকটাই নির্ভর করে। সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়ে গেলেই ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কিন্তু শুধু বঙ্গোপসাগরেই কেন? ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে যে আরব সাগরের অবস্থান, সেই আরব সাগরেও তো একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সম্ভব। মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ স্থলভাগের পূর্ব দিকের কিনারায় যেমন বঙ্গোপসাগরের অবস্থান, ঠিক তেমনই তো ওই স্থলভাগের পশ্চিম দিকের কিনারায় আরব সাগর রয়েছে।
আরও পড়ুন, ‘শুনুন জল জমে গিয়েছে, ঝড় হচ্ছে, অন্ধকারে বসে আছি’
আরব সাগরে যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না, তা নয়। ঘূর্ণিঝড় আরব সাগরেও তৈরি হয়। কিন্তু সে সব ঝড়ের অধিকাংশই পশ্চিম দিকে চলে যায় অর্থাৎ মধ্য এশিয়ার উপকূলে গিয়ে আঘাত হানে। কারণ, প্রথমত ভারতের পশ্চিম উপকূল জুড়ে বিস্তৃত পাহাড়ে হাওয়া বাধা পায়। দ্বিতীয়ত মধ্য ভারতের চেয়ে মধ্য এশিয়ার দিকে নিম্নচাপের তীব্রতা অধিকাংশ সময়েই বেশি থাকে।
তবে এ কথাও ঠিক যে, বঙ্গোপসাগরে যে সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় জন্ম নেয়, আরব সাগরে তত ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না। আরব সাগরের চেয়ে বঙ্গোপসাগর অনেক বেশি উত্তাল বা অশান্ত বলেই এমনটা হয়।
চলছে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব।
পশ্চিমবঙ্গের উপকূল এমনই একটা অবস্থানে রয়েছে যে, খুব কম সংখ্যক সাইক্লোনই সরাসরি এই উপকূলের দিকে আসে। ঘুর্ণিঝড়গুলোর জন্ম মূলত হয় আন্দামান এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মাঝামাঝি এলাকায়। ওই অঞ্চল থেকে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আঘাত হানার প্রবণতা কমই থাকে। কারণ হয় পূর্বে, না হয় পশ্চিমে যাওয়ার প্রবণতাই বেশি থাকে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া সাইক্লোনগুলোর। তাই এই সব সাইক্লোন হয় তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রপ্রদেশে আঘাত হানে। না হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় বাংলাদেশ বা মায়ানমারের দিকে। ওড়িশা উপকূলে আঘাত হানা সাইক্লোনের সংখ্যাও কম নয়। ওই সব সাইক্লোনের প্রভাব প্রায় প্রত্যেক বারই পশ্চিমবঙ্গে পড়ে। সাইক্লোন ফণী যে ভাবে ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ে ক্রমশ উত্তর-পূর্ব দিকে যাচ্ছে, তাতে এর চূড়ান্ত গন্তব্য সেই বাংলাদেশই। কিন্তু এর গতিপথটা দক্ষিণবঙ্গের অনেকগুলো জেলাকেই ছুঁয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন, ভয়াবহ ফণীর ছোবলে বিধ্বস্ত ওড়িশা, দেখে নিন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সেই ছবি
একটা বিষয় অবশ্য ফণীর ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। ওড়িশার স্থলভাগের খুব গভীরে কিন্তু এই সাইক্লোন ঢুকছে না। উপকূল বরাবরই এই সাইক্লোন ক্রমশ উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁক নিচ্ছে। এই প্রবণতা বহাল থাকলে উপকূলবর্তী দুই মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা ছাড়া অন্যান্য জেলায় সাইক্লোনের ঝাপটা খুব জোরে লাগবে না। কলকাতাও অনেকটাই রেহাই পেয়ে যেতে পারে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের উপকূল ছুঁয়ে বাংলাদেশের যশোহর, নোয়াখালির দিকে ঘুরে যাওয়ার একটা প্রবণতা এই সাইক্লোনটার মধ্যে দেখছি। তবে যতক্ষণ না সাইক্লোনটা বেরিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ তার গতিবিধি সম্পর্কে খুব নিশ্চিত ভাবে কিছুই বলা সম্ভব নয়।
কোন সাইক্লোনটা ভারতের পূর্ব উপকূলের দিকে আসবে, তা নির্ভর করে ঘূর্ণাবর্তটার অক্ষের উপরে। কোন দিক থেকে কোন দিকে প্রলম্বিত ঘূর্ণাবর্তের অক্ষ, তা দেখেই বোঝা যায়, ঝড়টা কোন দিকে গিয়ে আছড়ে পড়বে। সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আছড়ে পড়ার মতো অক্ষ তৈরি হতে সচরাচর দেখা যায় না। তবে এ বারের সাইক্লোন ওড়িশার এমন একটা এলাকায় ধাক্কা মারল এবং সেখান থেকে যে দিকে বাঁক নিল, তাতে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে বড়সড় ধাক্কা লাগা অনিবার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy