প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
একটি দিনের একটি পরীক্ষা। তাতেই উড়েছে কোটি কোটি টাকা!
যেমন? পরীক্ষার দিনকয়েক আগেই হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রাম চ্যানেলে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি! বিষয়পিছু টাকার অঙ্কটা কমবেশি ১৫ থেকে ২০ লক্ষ। অর্থাৎ চারটি বিষয়ের জন্য ৬০ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা! উত্তর লিখে দেওয়ার জন্য ‘সলভার গ্যাং’ও রয়েছে। তারা সঠিক উত্তর লিখে দেওয়ার জন্য পরিক্ষার্থী-পিছু ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়েছে বলে প্রাথমিক অনুমান।
কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিজের রাজ্যের বদলে ভিন্ রাজ্যে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন বহু পড়ুয়া! সেখানে প্রায় কোনও উত্তর না লিখলেও ওএমআর শিটে ‘সঠিক উত্তর’ লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল! এ জন্য একাধিক পড়ুয়ার পরিবারের তরফে ব্ল্যাঙ্ক চেকও দেওয়া হয়েছে!
ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট-এর ২০২৪ সালের ফলাফল নিয়ে কেলেঙ্কারির পরে পুলিশের তদন্তে এমনই নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। সব মিলিয়ে কত টাকার খেলা? উত্তর এখনই দিতে নারাজ তদন্তকারীরা। কারণ, হিসাব চলছে। মাত্র দু’তিনটি রাজ্যে তদন্তে নেমেই প্রাথমিক ভাবে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা নগদ লেনদেনের ইঙ্গিত পেয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া রয়েছে ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়ার ঘটনা। এ বছর পরীক্ষা দিয়েছিলেন প্রায় ২৪ লক্ষ পড়ুয়া। পুলিশ এবং শিক্ষা মহলের অনুমান, এঁদের একটা ছোট্ট অংশও যদি এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, তা হলেই একটি দিনের পরীক্ষায় কেলেঙ্কারির অঙ্ক অন্তত হাজার কোটি ছাপিয়ে যেতে পারে।
প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের অনুমান, কেলেঙ্কারির জাল ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, হরিয়ানা, গুজরাত, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক-সহ একাধিক রাজ্যে। কয়েকটি কোচিং সেন্টারও আতশকাচের নীচে। রয়েছে পরীক্ষা-মাফিয়াদের দলও। ইতিমধ্যেই সঞ্জীব মুখিয়া এবং বিট্টু নামে দু’জনকে হাতে পেয়েছে পুলিশ। ‘পরীক্ষা মাফিয়া’ নামে পরিচিত সঞ্জীব মুখিয়া ২০১৬ সালে নিট-এর প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে উত্তরাখণ্ড পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। অন্য অভিযুক্ত বিট্টুও পরীক্ষা-মাফিয়া নামেই চিহ্নিত।
গত ৫ মে, রবিবার নিট ইউজি পরীক্ষা হয়। সে দিনই পটনার বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে প্রশ্নের ফোটোকপি বিলি করার অভিযোগ পায় পুলিশ। শাস্ত্রীনগরে একটি পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে ঝাড়খণ্ডের নম্বরপ্লেট যুক্ত একটি গাড়ি থেকে অনেক অ্যাডমিট কার্ড উদ্ধার করে পুলিশ। চার জন পড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, তাঁরা আগের দিনই প্রশ্নপত্র পেয়ে গিয়েছিলেন! এর পরেই ‘সিট’ গঠন করে তদন্তে নামে পটনা পুলিশ। একটি সূত্রের দাবি, পরীক্ষার দিন কয়েক আগে ৬০ কোটি টাকার বিনিময়ে উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রশ্ন ‘কিনে’ বিহারে নিয়ে আসে একদল পরীক্ষা-মাফিয়া। তদন্তে নেমে পুলিশ সিকন্দর যুজবেন্দ্র, অখিলেশ ও বিট্টুকে গ্রেফতার করে। তাদের জেরা করে পটনার একটি স্কুলের পড়ুয়া আয়ুষ রাজকে হাতে পায় পুলিশ। আয়ুষ পুলিশকে লিখিত বয়ানে জানিয়েছেন, তাঁকে ৪ মে, শনিবার রামকৃষ্ণনগর থানার খেমনীচক এলাকায় একটি হস্টেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরও অন্তত ২৫ জন পরীক্ষার্থী হাজির ছিলেন। তাঁদের সকলকেই প্রশ্নপত্র এবং উত্তর দিয়ে রাতের মধ্যে সেগুলি মুখস্থ করে ফেলতে বলা হয়। পরের দিন তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় পরীক্ষা কেন্দ্রে। এই সতর্কতার কারণ, যাতে তাঁদের কাছ থেকে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি জানাজানি না হয়।
জেরায় আয়ুষ জানিয়েছেন, পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে হুবহু একই প্রশ্নপত্র তিনি হাতে পান। আয়ুষের পাশাপাশি গ্রেফতার হন শিবনন্দন যাদব, অনুরাগ যাদব, অভিষেক কুমার নামে আরও তিন জন। জানা গিয়েছে, পড়ুয়াপিছু ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস বা উত্তর লিখে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেফতার করেছে বিহার পুলিশ। এখন খোঁজ চলছে ‘সলভার গ্যাং’-এর।
তবে সবাইকে চমকে দিচ্ছে গুজরাতের গোধরা। ২০০২-এ মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের গোড়ার দিকে দাঙ্গার কারণে শিরোনামে উঠে আসা গোধরা এ বারে নিট-কেলেঙ্কারির দৌলতেও ফের শিরোনামে। সেখানকার জয় জলরাম স্কুলে পরীক্ষা দেওয়া ৩০ জন সন্দেহের তালিকায় বলে জানিয়েছে পুলিশ। যাঁদের মধ্যে অনেকেই ভিন্ রাজ্যের (ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, কর্নাটক) পড়ুয়া। প্রশ্ন উঠছে, নিজের রাজ্য ছেড়ে গোধরার ওই কেন্দ্রে তাঁরা পরীক্ষা দিতে গেলেন কেন? প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, ওই গোটা কেন্দ্রটিই জালিয়াতিতে যুক্ত! ‘রয় ওভারসিজ় কোচিং সেন্টার’ নামে একটি কোচিং সেন্টারের দিকে আঙুল উঠেছে। তদন্তে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, বেশ কিছু পড়ুয়ার বাবা-মা ওই কোচিং সেন্টারটির পাশাপাশি কয়েক জন শিক্ষক ও সেন্টার সুপারভাইজ়ারকে ২ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ গোটা পরীক্ষাকেন্দ্রটিই বিকিয়ে গিয়েছিল! পড়ুয়াপিছু ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে উত্তর লিখে দেওয়ার ভার পেয়েছিলেন কয়েক জন শিক্ষক! ওই স্কুলের প্রিন্সিপালও এই কাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ!
গোধরার পঞ্চমহলের পুলিশ সুপার হিমাংশু সোলাঙ্কি জানিয়েছেন, জয় জলরাম স্কুলে পরীক্ষার আগেই অভিযান চালিয়ে পরীক্ষা পর্যবেক্ষক তুষার ভট্টের গাড়ি থেকে ৭ লক্ষ টাকা নগদ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল পুরুষোত্তম শর্মা, একটি কোচিং সেন্টারের মালিক পরশুরাম রায়-সহ ৫ জনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। এর মধ্যে পরশুরাম রায়ের দফতর থেকে নগদ কয়েক লক্ষ টাকা, একাধিক চেক মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা এবং ৮টি ব্ল্যাঙ্ক চেক উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ-কর্তার দাবি, সেখান থেকে মিলেছে ওই কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়া পড়ুয়াদের নামের তালিকাও। সব মিলিয়ে ওই একটি কেন্দ্রেই অন্তত ১২ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল বলে প্রাথমিক অনুমান পুলিশের। হিমাংশু জানিয়েছেন, পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, পড়ুয়ারা যে-সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না, সেগুলি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে শিক্ষকেরা লিখে উত্তরপত্র সিল করে পাঠিয়ে দেবেন। ফলে পাশ প্রায় নিশ্চিত!
পিছিয়ে নেই হরিয়ানাও। সেখানে একটি পরীক্ষা কেন্দ্র থেকেই ৬ জন প্রথম হয়েছেন! আরও অবাক ব্যাপার, নিটের ওয়েবসাইটে তাঁদের শুধু নাম আছে, পদবি নেই! সেখানে কত টাকার লেনদেন হয়েছে, তা এখনও সামনে আসেনি। তবে শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান পুলিশের তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়নি বলে ঘোষণা করে দেওয়ায় অনেকের আশঙ্কা, এ বারে না তদন্ত থমকে যায়।
সাম্প্রতিক কালে দেশ জুড়ে হইচই ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষায় নিয়োগ কেলেঙ্কারি। তার আগে প্রায় দু’দশক ধরে চলা মধ্যপ্রদেশের ‘ব্যপম’ কেলেঙ্কারিতে একাধিক মানুষের অপমৃত্যু পর্যন্ত হয়েছিল। আর এ বার নিট কেলেঙ্কারি শুধু টাকার অঙ্কে এগিয়ে যাচ্ছে তা-ই নয়, এক ধাক্কায় ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যতকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। আগামী দিনের চিকিৎসকদের অনিশ্চয়তায় অনিশ্চিত গোটা দেশের ভবিষ্যৎও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy