গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল ২ লক্ষ। ১ থেকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ১১০ দিন। কিন্তু ১ লাখ থেকে ২ লাখে পৌঁছতে সেই সময় লেগেছে মাত্র ১৫ দিন। আক্রান্তের এই পরিসংখ্যানই বুঝিয়ে দিচ্ছে, দেশে কী ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা। ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভারত ভাল অবস্থানে রয়েছে বলে প্রথম দিকে যে দাবি করা হচ্ছিল, এখন আর সেটা বলতে ভরসা পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।
বুধবার সকালে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে আট হাজার ৯০৯ জন। দৈনিক নতুন সংক্রমণ বৃদ্ধির সংখ্যায় যা এখনও অবধি সর্বোচ্চ। এক দিনে এত সংখ্যক লোক এর আগে সংক্রমিত হননি। এই বৃদ্ধির জেরে দেশে মোট কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা হল দু’লক্ষ সাত হাজার ৬১৫ জন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্য অনুসারে গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ২১৭ জনের। এ নিয়ে দেশে মোট পাঁচ হাজার ৮১৫ জনের মৃত্যু হল করোনাভাইরাসের কারণে। এর মধ্যে দু’হাজার ৪৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে মহারাষ্ট্রে। গুজরাতে এক হাজার ৯২ জনের। রাজধানী দিল্লিতে মোট ৫৫৬ জন মারা গিয়েছেন করোনার থাবায়। কোভিডের জেরে মধ্যপ্রদেশে মৃতের সংখ্যা ৩৬৪, পশ্চিমবঙ্গে ৩৩৫। শতাধিক মৃত্যুর তালিকায় রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (২২২), রাজস্থান (২০৩), তামিলনাড়ু (১৯৭)-র মতো রাজ্য।
কেরল দিয়ে দেশের সংক্রমণ শুরু হওয়ার কিছু দিন পরই শীর্ষে চলে আসে মহারাষ্ট্র। এখনও আক্রান্তের নিরিখে শীর্ষে সেই মহারাষ্ট্র। গত ২৪ ঘণ্টায় দু’হাজার ২৮৭ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন সেখানে। সে রাজ্যে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭২ হাজার ৩০০ জন। মোট আক্রান্তের নিরিখে এর পরই তামিলনাড়ু। সেখানে আক্রান্তের মোট সংখ্যা ২৪ হাজার ৫৮৬। দিল্লিতে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২২ হাজার ১৩২ জন ও গুজরাতে ১৭ হাজার ৬১৭ জন। এর পর ক্রমান্বয়ে রয়েছে রাজস্থান (৯,৩৭৩), মধ্যপ্রদেশ (৮,৪২০), উত্তরপ্রদেশ (৮,৩৬১), পশ্চিমবঙ্গ (৬,১৬৮), বিহার (৪,১৫৫), অন্ধ্রপ্রদেশ (৩,৮৯৮), কর্নাটক (৩,৭৯৬), তেলঙ্গানা (২,৮৯১), জম্মু-কাশ্মীর (২,৭১৮), হরিয়ানা (২,৬৫২), পঞ্জাব (২,৩৪২), ওড়িশা (২,২৪৫), আসাম (১,৫১৩), কেরল (১,৪১২) ও উত্তরাখণ্ড (১,০৪৩)।
পশ্চিমবঙ্গেও বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। কলকাতার আশপাশ ছাড়িয়ে দূরের বিভিন্ন জেলাতেও বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা। এখনও অবধি করোনাভাইরাসে রাজ্যে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ছ’হাজার ১৬৮ জন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের হিসেবে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯৬ জন। এখনও অবধি রাজ্যে মোট মৃত্যু হয়েছে ৩৩৫ জনের। যদিও রাজ্য সরকারের প্রকাশিত বুলেটিনের হিসেবে, সরাসরি করোনাভাইরাসের জেরে মৃতের সংখ্যা ২৬৩। বাকি ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে কোমর্বিডিটির কারণে।
করোনাভাইরাসে যেমন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তেমন সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যাটাও নেহাত কম না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এটাই যেন আশার আলো। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর এখনও অবধি সুস্থ হয়েছেন এক লক্ষ ৩০৩ জন। তার মধ্যে চার হাজার ৭৭৬ জন সুস্থ হয়েছেন গত ২৪ ঘণ্টায়।
অথচ শুরুর দিকে এমনটা ছিল না। ভারতে প্রথম কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট ধরা পড়ে উহান ফেরত কেরলের এক ছাত্রীর। তার পর থেকে সময় যত গড়িয়েছে প্রতি দিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই মোট আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়েছে। আর প্রায় চার মাস পর সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল ২ লক্ষ। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজারের ধাপে যদি ভাগ করা যায়, তা হলে দেখা যাচ্ছে, প্রথম ৫০ হাজার পৌঁছতে সময় লেগেছে ৯৮ দিন। দ্বিতীয় ৫০ হাজার অর্থাৎ মোট আক্রান্ত ১ লক্ষে পৌঁছনোর মেয়াদ ১২ দিন। সেখান থেকে দেড় লক্ষে পৌঁছেছে ৮ দিন পর। আর সর্বশেষ ৫০ হাজার আক্রান্ত যোগ হয়েছে মাত্র ৭ দিনে। সংক্রমণ বৃদ্ধির এই গ্রাফ নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
উদ্বেগের কারণ রয়েছে পাঁচ দিনের মুভিং অ্যাভারেজ বা চলন্ত গড়েও। কোনও একটি চলমান বিষয়ের কোনও একটি দিনের পরিসংখ্যান তার আগের দু’দিন এবং দু’দিন পরের হিসেবের গড়কেই পাঁচ দিনের চলন্ত গড় বলা হয়। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমান তালে বেড়েছে এই চলন্ত গড়ও। মার্চের ৪ তারিখে এই গড় ছিল ৬। অর্থাৎ ওই পাঁচ দিনে গড়ে ৬ জন মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। ৩১ মার্চে এসে সেই গড় হয়ে যায় ২৩০। আবার এক মাস পর ৩০ এপ্রিল এই গড় ছিল ১ হাজার ৮৭৯। ৩১ মে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় পৌঁছে গিয়েছে ৮ হাজার ৭৫-এ। বলা বাহুল্য, সময় যত গড়াবে, এই গড় আরও বাড়তে থাকবে, যদি না নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কমে।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
একটা সময় সরকার এবং দেশের চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞ মহল দাবি করছিল, ভারত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অন্য বহু দেশের থেকে কয়েক গুণ এগিয়ে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে আর সেই দাবি করার সাহস দেখাচ্ছেন না অনেকেই। ইটালি, স্পেন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মতো দেশে যখন ভয়াবহ আকার নিয়েছে এই ভাইরাস, তখনও বিশ্বের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল অনেক নীচে। সেখান থেকে উঠতে উঠতে এখন চলে এসেছে সপ্তম স্থানে। ভারতের আগে এখন আমেরিকা, ব্রাজিল, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, স্পেন ও ইটালি। কিন্তু ভারতের উপরে থাকা অধিকাংশ দেশেরই দাবি, আক্রান্তের শিখর পেরিয়ে এসেছে তারা এবং এখন সংক্রমণ কমছে। কিন্তু ভারতে এখনও নতুন সংক্রমণের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে এই দেশগুলিকেও আক্রান্তের সংখ্যায় টপকে যাওয়া কার্যত সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকে।
আরও পড়ুন: কোভিড পরীক্ষা বাড়াতে কিছু রাজ্যে ‘ট্রু-ন্যাট’ পাঠাচ্ছে কেন্দ্র
কিন্তু কোথায় গিয়ে থামবে? কত দিন পর শেষ হবে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার? ভারত কি সংক্রমণের শিখর পেরিয়ে এসেছে? আপাতত এই প্রশ্নের উত্তর অধরা। এ নিয়ে কেউই তেমন মুখ খুলতে চাইছেন না। আবার যে দু’একটি সংগঠন বা সমীক্ষক সংস্থা হিসেব দিচ্ছে, তাদের একের সঙ্গে অন্যের পূর্বাভাসে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ফলে তাতে কোনও উপসংহারে আসার উপায় নেই।
দেশে চার দফায় ২ মাস ৮ দিন লকডাউন চলেছে। ১ জুন থেকে শুরু হয়েছে আনলক-১। লকডাউন শিথিল করে অর্থনীতি পুরো সচল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, লকডাউনে যে কার্যত কোনও ফল হয়নি, প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মোট আক্রান্তের পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট। তার মধ্যে আনলক-১ শুরু হতেই রাস্তাঘাটে ভিড় বাড়ছে। খুলছে সরকারি-বেসরকারি অফিস। তাতে সংক্রমণ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিয়েছে করোনা’, মোদীর দাবিতে উঠছে প্রশ্ন
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার ঢল। রাজ্যে রাজ্যে প্রতিদিন ট্রেনে-বাসে করে ফিরছেন শ্রমিকরা। তাঁদের সবার স্ক্রিনিং-টেস্ট হচ্ছে। ফলে এক দিকে যেমন টেস্টের সংখ্যা বাড়ছে, তেমনই পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে আক্রান্তের প্রবণতাও বেশি। এর পর লোকাল ট্রেন, মেট্রো, বেসরকারি বাস চালু হলে সংক্রমণ যে কী হারে বাড়তে পারে, তা ভেবেই আঁতকে উঠছেন অনেকে।
অনেকেই টেস্টের সংখ্যা বৃদ্ধির যুক্তি দিচ্ছেন। অর্থাৎ বেশি সংখ্যক মানুষের টেস্ট হচ্ছে বলেই আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু সরকারি নিয়মে করোনার সংক্রমণের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, এমন কারও টেস্ট হচ্ছে না। কোনও কোভিড আক্রান্তের সংস্পর্শে আসাদেরই কোভিড টেস্ট হচ্ছে। কিন্তু সেই টেস্ট তো করতেই হত এবং আগামী দিনেও করতে হবে। আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়বে, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তির সংখ্যাও বাড়বে। অর্থাৎ আক্রান্তের আক্রান্তের সংখ্যা না কমা পর্যন্ত টেস্টের সংখ্যাও কমবে না।
রয়েছে জনসংখ্যার তত্ত্বও। ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখাটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। সেই দিক থেকে দেখলে অবশ্য পাশ্চাত্যের দেশগুলির চেয়ে এখনও কিছুটা স্বস্তিদায়ক জায়গায় রয়েছে দেশ। সেই সঙ্গে ভারতে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম। আবার সুস্থ হয়ে ওঠার হারও বেশি। সংক্রমণের এই বিপুল বৃদ্ধির মধ্যেও স্বস্তি বলতে এইটুকুই।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
(চলন্ত গড় বা মুভিং অ্যাভারেজ কী: একটি নির্দিষ্ট দিনে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় হল— সেই দিনের সংখ্যা, তার আগের দু’দিনের সংখ্যা এবং তার পরের দু’দিনের সংখ্যার গড়। উদাহরণ হিসেবে— দৈনিক নতুন করোনা সংক্রমণের লেখচিত্রে ১৮ মে-র তথ্য দেখা যেতে পারে। সে দিনের মুভিং অ্যাভারেজ ছিল ৪৯৫৬। কিন্তু সে দিন নতুন আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৫২৬৯। তার আগের দু’দিন ছিল ৩৯৭০ এবং ৪৯৮৭। পরের দুদিনের সংখ্যা ছিল ৪৯৪৩ এবং ৫৬১১। ১৬ থেকে ২০ মে, এই পাঁচ দিনের গড় হল ৪৯৫৬, যা ১৮ মে-র চলন্ত গড়। ঠিক একই ভাবে ১৯ মে-র চলন্ত গড় হল ১৭ থেকে ২১ মে-র আক্রান্তের সংখ্যার গড়। পরিসংখ্যানবিদ্যায় দীর্ঘমেয়াদি গতিপথ সহজ ভাবে বোঝার জন্য এবং স্বল্পমেয়াদি বড় বিচ্যুতি এড়াতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy