—প্রতীকী ছবি।
এত দিন ধরে দেশে চালু থাকা ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি বদলে দিয়ে মোদী সরকার দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুললেন। ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, ভারতীয় সাক্ষ্য আইন তুলে দিয়ে মোদী সরকার ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ও ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম চালু করতে চাইছে। বিরোধীদের দাবি, এর লক্ষ্য হল, পুলিশের হাতে দানবীয় ক্ষমতা তুলে দিয়ে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া।
সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী, ইউপিএ সরকারের আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল একে ‘পুরোপুরি অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে অভিযোগ তুলেছেন, তিনটি প্রস্তাবিত আইন বিচারবিভাগের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। মোদী সরকার যে দেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে চায় না, তা এখন স্পষ্ট। কংগ্রেসের অভিযোগ, সরকারের দাবি মোতাবেক বাকস্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ মোটেই তুলে দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শুধু রাষ্ট্রদ্রোহের প্রসঙ্গ ফিরিয়েই আনছেন না। রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা এমন ভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে তার যথেচ্ছ অপব্যবহার করা যায়। তিনটি আইনের সঙ্গেই সংবিধানের মৌলিক অধিকার জড়িত। তাতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
শুক্রবার সংসদের বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে আচমকাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় তিনটি বিল পেশ করেন। ব্রিটিশ জমানায় তৈরি ভারতীয় দণ্ডবিধির বদলে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ফৌজদারি কার্যবিধির বদলে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ও ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের বদলে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম চালু করতে এই তিনটি বিল পেশ করা হয়েছে।
তিনটি বিল খতিয়ে দেখে রবিবারই প্রথম কংগ্রেস এতে নিজেদের মতামত জানিয়েছে। কংগ্রেসের অভিযোগ, মোদী সরকার দেশের অপরাধ সংক্রান্ত আইন, বিচারের গোটা ব্যবস্থাই বদলে ফেলতে চাইছে। এত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আইনে বদল আনার আগে মোদী সরকার তা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনাই করেনি। হঠাৎ তিনটি বিল জাদুকরের কালো টুপি থেকে বার করে আনা হয়েছে বলে কটাক্ষ করেছে কংগ্রেস।
কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, এ বিষয়ে জনগণের মতামত দূরের কথা, আইনজ্ঞ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মতামতও চাওয়া হয়নি। সবটাই গোপনে, লুকিয়ে, অস্বচ্ছতার সঙ্গে করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। কংগ্রেসের দাবি, শুধু সংসদের স্থায়ী কমিটিতে নয়, মোদী সরকারের নতুন তিনটি বিল নিয়ে প্রাক্তন বিচারপতি, আইনজীবী, আইনজ্ঞ, অপরাধবিজ্ঞানীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হোক।
প্রবীণ আইনজীবী তথা রাজ্যসভার সাংসদ কপিল সিব্বল রবিবার দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ তুলেছেন, মোদী সরকার মুখে ব্রিটিশ আইন তুলে দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু নতুন আইনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থেকে হাই কোর্টের বিচারপতি, ম্যাজিস্ট্রেট, সিএজি-সহ সকলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের রাস্তা খোলা রাখা হয়েছে। এখন কাউকে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থা গ্রেফতার করলে জেরা করার জন্য, তদন্তের স্বার্থে সর্বাধিক ১৫ দিন নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ৬০ দিন বা ৯০ দিন করা হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে বিপদের মুখে ফেলার নতুন অপরাধ যোগ করা হয়েছে। সিব্বল বলেন, “এর উদ্দেশ্য হল, বিরোধীদের মুখ বন্ধ করা। আমি বিচারপতিদের সতর্ক হতে বলব। এই আইন পাশ হলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। সরকারের এই বিল ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। আমরা গোটা দেশে ঘুরে প্রচার করব যে, এই আইনে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হচ্ছে।” তাঁর মতে, যদি এই বিল পাশ হয়, তা হলে সব প্রতিষ্ঠানে শুধু সরকারের কথাই চলবে।
প্রস্তাবিত ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ ফিরিয়ে আনার মধ্যেও একই বিপদ দেখছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের তরফে রাজ্যসভার সাংসদ রণদীপ সুরজেওয়ালা বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জোর গলায় বলেছেন, বাকস্বাধীনতার রক্ষায় রাষ্ট্রদ্রোহের আইন তুলে দেওয়া হচ্ছে। বাস্তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় রাষ্ট্রদ্রোহের আইনকে আরও দানবীয় করে তোলা হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে খুশি মতো তার অপব্যবহার করা যায়।”
সরকারি পদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের রাস্তা খোলার মধ্যেও সিব্বলের মতোই সুরজেওয়ালা বিপদ দেখছেন। এখন আইনে রয়েছে, সরকারি পদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। ৯০ বা ১২০ দিনের মধ্যে সেই অনুমতি দিতে হবে। সুরজেওয়ালার বক্তব্য, এই সময়সীমা আগেও ছিল। নতুন বিলে বলা হয়েছে, ওই সময়সীমার মধ্যে অনুমতি না মিললে, অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে।
কংগ্রেসের বক্তব্য, নতুন বিলে ই-এফআইআর, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে কড়া শাস্তি, নাবালিকাদের বিরুদ্ধে অপরাধে কড়া শাস্তি, গণধর্ষণে কড়া শাস্তির কথা তুলে ধরে মোদী সরকার দেখাতে চাইছে, আইনে বড় সংস্কার হচ্ছে। মানুষের সুবিধা হবে। বাস্তবে এই সব ধারা এখনই চালু রয়েছে। যেখানে আসলে বদল করা হচ্ছে, তা মোদী সরকার ধামা চাপা দিয়ে রাখতে চাইছে।
লোকসভার কংগ্রেস সাংসদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মণীশ তিওয়ারি বলেন, “১৮৬০ সালের ভারতীয় দণ্ডবিধি, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি ও ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন নিয়ে গত একশো-দেড়শো বছর ধরে আইনি বিচার চলছে। তার প্রতিটি ধারার আইনি ব্যাখ্যা সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রিভি কাউন্সিল, ফেডেরাল কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্টগুলি এ নিয়ে চুলচেরা বিচার করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয় বলে ফৌজদারি কার্যবিধিতে রাজ্য স্তরে সংশোধন হয়েছে। এখন মোদী সরকারের নতুন তিনটি বিল নিয়ে তার ভিত্তিতে আলোচনা হওয়া উচিত। এ জন্য সংসদীয় যৌথ কমিটি তৈরি হোক। তাতে আইনজীবী, প্রাক্তন বিচারপতি, পুলিশ, আমলা, মানবাধিকার কর্মীরাও থাকুন। কারণ এই তিনটি প্রস্তাবিত আইনের সঙ্গে সংবিধানের মৌলিক অধিকার ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy