চোখে জল প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের। রবিবার নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনের অনুষ্ঠানে প্রেম সিংহের তোলা ছবি।
চোখে জল। আবেগে বুজে আসছে গলা। লক্ষ লক্ষ মামলার ভারে এ দেশের বিচারপতিরা কী প্রচণ্ড চাপের মুখে কাজ করছেন, তা বলতে গিয়ে বারবার রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছছেন প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর। নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও হাইকোর্টগুলির প্রধান বিচারপতিরাও বাগ্রুদ্ধ।
নজিরবিহীন ঘটনা। কিন্তু প্রধান বিচারপতির এই আবেগের সামনে মুখ খুলতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী। আশ্বাস দিলেন, বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করেই সমস্যার সমাধান খুঁজবেন তিনি।
আদালতে ঝুলে থাকা লক্ষ লক্ষ মামলা, বিচারপতিদের শূন্য পদ— এ সব নিয়ে এত দিন বিচারবিভাগ, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে দড়ি টানাটানিই চলত। আঙুল উঠত বিচার ব্যবস্থার দিকে। সমস্যার সমাধানে বিচারকদের সংখ্যা বাড়ানোর আবেদন জানাতে গিয়েই আজ কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রধান বিচারপতি ঠাকুর। বললেন, ‘‘তিন দশক ধরে বিচারপতিদের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব হিমঘরে ফেলে রাখা হয়েছে। বিচারপতিরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজ করছেন। আপনারা পুরো বোঝা বিচারবিভাগের উপর ঠেলে দিতে পারেন না।’’ বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠনে মোদী সরকারের প্রস্তাব খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট। যা নিয়ে বিচারবিভাগ ও সরকারের মধ্যে সংঘাত হয়। সে বিষয় আজ প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, গত এক বছর ধরে এই মামলা চলায় সব হাইকোর্টে বিচারপতিদের নিয়োগ বন্ধ ছিল। এ জন্য ৪৩৪টি শূন্যপদ তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞান ভবনে মুখ্যমন্ত্রী ও বিচারপতিদের সম্মেলনে প্রধান বিচারপতির এই সব মন্তব্যের পরে অস্বস্তিতে মোদী সরকার। প্রথমে ঠিক ছিল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির থাকলেও প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দেবেন না। কারণ তাঁকে ঝাড়খণ্ডে পঞ্চায়েত মন্ত্রকের অনুষ্ঠানে যেতে হবে। কিন্তু তার পর নির্ধারিত সময়ের পরেও ২০ মিনিট অনুষ্ঠানে থেকে যান মোদী। পরিবেশ হাল্কা করতে মন্তব্য করেন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এই সম্মেলনে এসেই তিনি আদালতের ছুটি কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর বিচারপতিরা তাঁর উপরে চটে গিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষের আগে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে যান, তিনি সমস্যা শুনে চলে যাওয়ার লোক নন। তিনি ও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বিচারপতিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা হবে।
বিচারক-বিচারপতির সংখ্যাটা কতখানি বাড়ানো প্রয়োজন? প্রধান বিচারপতি বলেছেন, দেশের সমস্ত আদালতে প্রায় ৩৮ লক্ষ মামলা পড়ে রয়েছে। হাইকোর্টগুলিতে মামলার সংখ্যা ৩৬ লক্ষের বেশি। ১৯৮৭-তে আইন কমিশন প্রতি দশ লক্ষ মানুষের জন্য বিচারপতির সংখ্যা ১০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করার কথা বলেছিল। এ জন্য বিচারকের সংখ্যা ৪০ হাজারে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এই তিন দশকে ২৫ কোটি জনসংখ্যা বেড়েছে। আর্থিক বৃদ্ধির হারে ভারত সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে। অথচ বিচারপতির সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার নড়ে বসেনি। এখনও তাই বিচারক-বিচারপতির সংখ্যা ২১ হাজার, প্রতি দশ লক্ষে মাত্র ১৫ জন।
ঠাকুর জানান, ২০০২-এ সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে রায় দেওয়ার পরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটিও একই সুপারিশ করে। ২০১৩-য় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীর এই বিষয়ে মনমোহন সিংহকে চিঠি লিখেছিলেন। মনমোহন জবাব দেন, তাঁরা রাজ্যগুলিকে অর্থসাহায্য করছেন। কেন্দ্র রাজ্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়েছে। রাজ্য বলেছে, তাদের কোষাগারে টাকা নেই। অথচ আজও এ দেশে এক জন বিচারক বছরে গড়ে ২৬০০ মামলার নিষ্পত্তি করেন। আমেরিকায় সেই সংখ্যাটা মাত্র ৮১।
শুধু কাতর আবেদন করেই প্রধান বিচারপতি আজ থামেননি। কেন্দ্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, মোদী সরকার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প করছে, বিদেশি লগ্নির আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু আদালতের পরিকাঠামো না বাড়ালে কোনও লাভ হবে না। কারণ বিদেশের কর্পোরেট সংস্থা বা লগ্নিকারীরাও দেখতে চাইবেন, এ দেশে মামলা মোকদ্দমার কত দ্রুত, কতখানি দক্ষতার সঙ্গে নিষ্পত্তি হয়।
লগ্নিকারী তথা শিল্পমহলের জন্যই বাজেটে প্রতিটি হাইকোর্টে পৃথক বাণিজ্যিক কোর্ট তৈরির ঘোষণা করেছিলেন অরুণ জেটলি। বিচারপতি ঠাকুর বলেন, প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো, বর্তমান বিচারপতিদের সেখানে নিয়োগ করে, একটি এজলাসের বাইরে ‘কমার্শিয়াল কোর্ট’-এর বোর্ড ঝুলিয়ে লাভ হবে না। কর্পোরেট সংস্থার কথা ভেবে আরামদায়ক পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে। নতুন বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে। ঠাকুর বলেন, ‘‘শুধু মামলাকারী ও বিনা বিচারে জেলে বন্দিদের জন্য বলছি না, দেশের উন্নয়নের জন্যই কাতর আবেদন করছি, বিচারক-বিচারপতিদের সংখ্যা বাড়ানো হোক। বুঝুন যে শুধু সমালোচনা করাই যথেষ্ট নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy