চাঁদের পথে চন্দ্রযান-৩। ছবি: পিটিআই।
তিন বছর আগের সেই ব্যর্থতার পর থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। সেই নিরলস প্রচেষ্টার প্রথম ধাপে সাফল্য এল শুক্রবার। অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের ‘লঞ্চিং প্যাড’ থেকে সফল উৎক্ষেপণ হল ‘চন্দ্রযান-৩’-এর।
কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ। যদি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান-৩ থেকে ল্যান্ডার বিক্রম সফল ভাবে চাঁদের মাটি ছুঁতে পারে এবং তার পরে রোভার প্রজ্ঞানকে সঠিক ভাবে অবতরণ করাতে পারে, তবে ভারতীয় মহাকাশ অভিযানের ইতিহাস নতুন মাত্রা পাবে। সে ক্ষেত্রে গত এক দশকে চিনের পর আরও কোনও দেশের মহাকাশযান সফল ভাবে চাঁদে অবতরণের নজির গড়বে। আমেরিকা, রাশিয়া, চিনের পরে চতুর্থ দেশ হিসাবে তালিকায় ঠাঁই পাবে ভারত।
চলতি বছরে মোট ছ’টি অভিযান হচ্ছে চাঁদে। সেই তালিকায় প্রথম চন্দ্রযান-৩। ২০১৯ সালের ২২ জুলাই শ্রীহরিকোটা থেকে ‘জিএসএলভি মার্ক থ্রি’ ওরফে ‘বাহুবলী’ রকেটে চাপিয়ে চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। তারও তিনটি অংশ ছিল— অরবিটার, ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান। ৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে প্রজ্ঞানকে পেটের ভিতরে নিয়ে ‘পাখির পালকের মতো অবতরণ’ (সফট ল্যান্ডিং) করার কথা ছিল বিক্রমের। অবতরণের পরে প্রজ্ঞান বিক্রমের শরীর থেকে বেরিয়ে আসত। চাঁদের মাটি ছোঁয়ার তিন মিনিট আগে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় ইসরোর। মহাকাশ বিজ্ঞানী ও ‘স্পেস ইঞ্জিনিয়ার’দের অনেকেরই ধারণা, অবতরণের সময় গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না-পেরেই চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়েছিল (হার্ড ল্যান্ডিং) বিক্রম।
সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এ বার অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন ইসরো বিজ্ঞানীরা। উৎক্ষেপণ পর্ব নির্বিঘ্নে কেটেছে। এ বার অবতরণের অপেক্ষা।
কী কাজ করবে চন্দ্রযান-৩?
ইসরোর তরফে জানানো হয়েছে প্রায় ৪০ দিন পরে, আগামী ২৩ বা ২৪ অগস্টের মধ্যে চাঁদের মাটিতে নামতে পারে চন্দ্রযান-৩-এর সৌরচালিত ল্যান্ডার। সেখান থেকে সৌরচালিত রোভার বেরিয়ে চাঁদের মাটি ছোঁবে। চাঁদের মাটির চরিত্র, বিভিন্ন খনিজ পদার্থের উপস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করবে রোভার প্রজ্ঞান। সূর্যোদয়ের সময়ই চাঁদের মাটিতে হবে অবতরণ পর্ব। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সূর্যাস্তের দু’সপ্তাহ পরে শেষ হবে কাজ। অবতরণের আগে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে অরবিটারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে চন্দ্রযান-৩। প্রসঙ্গত, চাঁদের যে গন্তব্যে পৌঁছনোর কথা চন্দ্রযান-৩-এর, সেখানে পৌঁছতে গেলে পৃথিবী, জিএসএলভি-মার্ক-৩ রকেট ও চাঁদের কক্ষপথকে (যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘লুনার ট্রান্সফার অরবিট’ বা ‘এলটিও’) একই তলে (প্লেন) থাকতে হবে। সেই সময়সূচি হিসাব করেই হয়েছে উৎক্ষেপণ।
কী ভাবে দেখা গেল চন্দ্রযানের উৎক্ষেপণ?
শুক্রবার দুপুর ২টো ৩৫মিনিটে চন্দ্রযান-৩-এর যাত্রার ২০ মিনিট আগেই ইসরো জানিয়েছিল, আবহাওয়া উৎক্ষেপণের অনুকূল। তাই পূর্বনির্ধারিত সূচি মেনেই উৎক্ষেপণ হবে। সেই সঙ্গে দেশবাসীকে চন্দ্রযানের উৎক্ষেপণ ও মহাকাশে যাত্রার ‘লাইভ সম্প্রচার’ দেখার সুযোগ দিতে একটি ইউটিউব চ্যানেলের লিঙ্কও প্রকাশ করা হয়।
#WATCH | Indian Space Research Organisation (ISRO) launches #Chandrayaan-3 Moon mission from Satish Dhawan Space Centre in Sriharikota.
— ANI (@ANI) July 14, 2023
Chandrayaan-3 is equipped with a lander, a rover and a propulsion module. pic.twitter.com/KwqzTLglnK
কী হয়েছিল দ্বিতীয় চন্দ্রযানের?
২০১৯ সালের ৭ জুলাই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে ‘সিমপেলিয়াস এন’ এবং ‘ম্যানজিনাস সি’ নামে দু’টি গহ্বরের মাঝখানে চন্দ্রযান ল্যান্ডার বিক্রম অবতরণের চেষ্টা করেছিল (এ বারও অবতরণ হবে দক্ষিণ মেরু অঞ্চলেই)। কিন্তু তা সফল হয়নি। পেটের মধ্যে রোভার প্রজ্ঞানকে নিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল বিক্রম। মাস তিনেক ধরে বিক্রমের ধ্বংসাবশেষের অনবরত খোঁজ চালিয়েছিল আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। কিন্তু কোনও ভাবেই তা চিহ্নিত করতে পারেনি তারা। শেষমেশ ‘লুনার রিকনাইস্যান্স অরবিটার’ (এলআরও)-এর তোলা একটি ছবি শেয়ার করে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্য চায় নাসা। সেই ছবি দেখে চেন্নাইয়ের এক জন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিক্রমের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেন। তাঁর সেই দাবি মেনে নেয় নাসা। তবে ল্যান্ডার এবং রোভার ধ্বংস হলেও ইসরোর অরবিটার এখনও চাঁদের কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করছে। চন্দ্রযান-৩ ব্যবহার করবে সেই অরবিটার।
কেন চাঁদে অভিযান ভারতের?
প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতের মতো দেশের পক্ষে চাঁদে রকেট পাঠিয়ে লাভ কী? দারিদ্র, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো বিস্তর সমস্যার মধ্যে থাকা ভারতের কি চাঁদে যাওয়ার তোড়জোড় সাজে? জবাবে বলা যায়, মহাকাশ অভিযান ভারতবাসীর জাতীয় গর্বের জায়গা। ২০১৪ সালে মঙ্গল অভিযানের সময় শিশুদের তা দেখার সুযোগ করে দিতে বদলে গিয়েছিল বিভিন্ন স্কুলের সময়সূচি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সে দিন বেঙ্গালুরুতে মঙ্গল মিশনের কন্ট্রোল রুমে হাজির ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘জাতি হিসেবে আমরা যে সক্ষম, এই সাফল্য তার উজ্জ্বল প্রমাণ।’’ শুক্রবার চন্দ্রযান-এর উৎক্ষেপণ উপলক্ষে বিদেশ সফর থেকেও টুইট করেছেন তিনি। ইসরোর বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘আমি আপনাদের সকলকে এই মিশন এবং মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনে আমাদের অগ্রগতি সম্পর্কে আরও জানতে অনুরোধ করছি। এই ঘটনা সকলকেই খুব গর্বিত করবে।’’
ভারতের ভবিষ্যৎ মহাকাশ-পরিকল্পনা কী?
১৯৮৪ সালের ৩ এপ্রিল রুশ মহাকাশযানে চড়ে মহাকাশে দিয়ে নজির গড়েছিলেন ভারতীয় নভশ্চর রাকেশ শর্মা। তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহাকাশচারী। চার দশক পরে দেশে তৈরি মহাকাশযানে চাপিয়ে ভারতীয় মহাকাশচারীদের মহাকাশে পাঠানোর লক্ষ্য নিয়েছে ইসরো। নাম দেওয়া হয়েছে ‘গগনযান মিশন’। ২০২৫ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা সফল করতে চায় ইসরো। পাশাপাশি, নাসার সঙ্গে যৌথ ভাবে ইসরোর মহাকাশ অভিযানের লক্ষ্যে ‘আর্টেমিস চুক্তি’তে সই করেছে ভারত। সূত্রের খবর, আর কয়েক বছরের মধ্যেই ইসরোর সঙ্গে যৌথ ভাবে মঙ্গল, শুক্র ও চন্দ্রাভিযানে নামবে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। শুধুই একে অন্যের মহাকাশযানে গবেষণার যন্ত্রপাতি পাঠানোর মধ্যেই সেই সব অভিযান সীমাবদ্ধ থাকবে না। সেগুলি আক্ষরিক অর্থেই হবে পুরদস্তুর ‘যৌথ অভিযান’। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা)-র সঙ্গে এখন যে ধরনের যৌথ মহাকাশ অভিযানে নামে নাসা, ঠিক সেই রকম ভাবেই পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা গড়ে তোলা হবে ইসরোর সঙ্গে। যৌথ উদ্যোগে ২০২৪ সালেই মহাকাশচারী পাঠানো হতে পারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy