অঙ্কন: সুমন চৌধুরী
অর্থনীতির হাল ফেরাতে সাহসী সংস্কার এবং নতুন শিল্প, কর্মসংস্থানের রাস্তা তৈরি। গরিব-মধ্যবিত্তকে সুরাহা দিয়ে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর মন্ত্রে আম আদমির মন জয়।
শনিবাসরীয় বাজেটে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সামনে। মোদী সরকারকে ঘিরে শিল্পমহলের প্রত্যাশা পূরণ করে বিনিয়োগের উপযুক্ত নীতি ও পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাতেই আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়বে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, আগামী অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার পৌঁছে যেতে পারে সাড়ে আট শতাংশে। দুই অঙ্কের বৃদ্ধির হারও অদূর ভবিষ্যতে অধরা থাকবে না। এই সম্ভাবনাকে সত্যি করার দায়িত্ব মোদীর কাঁধে।
যে তরুণ প্রজন্ম গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ঢালাও ভোট দিয়েছিল, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। আবার লোকসভা ভোটের ন’মাসের মধ্যে দিল্লির বিধানসভা ভোটে বিজেপির ভরাডুবি শাসক দলের অনেকের মনেই এই ধারণা তৈরি করেছে যে, আম আদমির কথা ভুলে গেলেও চলবে না। কাজেই একশো দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার প্রকল্পেও নজর দিতে হবে। সংসদে প্রধানমন্ত্রী যেমন জানালেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্প তুলে দেওয়ার কথা তিনি ভাবছেন না।
অর্থমন্ত্রী জেটলি বার বার বলেছেন, বৃদ্ধির চাকায় গতি বাড়াতে সংস্কার আর আম আদমির জন্য নীতি তৈরির মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। শিল্পের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে আর্থিক বৃদ্ধিকে টেনে তুলতে পারলেই সরকারের হাতে গরিবদের জন্য সামাজিক উন্নয়নে খরচ করার মতো অনেক বেশি টাকা থাকবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, দারিদ্র কমানো নয়, এখন সময় দারিদ্র একেবারে নির্মূল করে ফেলার। এবং শিল্পায়নই তার পথ। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র নীতিও সেই কারণেই। কিন্তু শুধু শিল্পমহলের কথা ভাবলে সরকার আম আদমির কথা ভুলছে বলে অভিযোগ উঠতে পারে। আবার উল্টোটা হলে মোদী সরকারও খয়রাতির সস্তা জনপ্রিয়তার রাজনীতি করছে বলে শিল্পমহল ক্ষুব্ধ হবে। এই সরু দড়ির উপর দিয়ে হাঁটাটাই মোদী-জেটলির পরীক্ষা।
শনিবারের বাজেট মোদী সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থমন্ত্রীর সামনে এ এক ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’। তিনি চাইলে নরসিংহ রাও জমানার মনমোহন সিংহের মতো ছক ভাঙা বাজেট তৈরি করতে পারেন। আর্থিক সংস্কারের সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ, সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সামনে কোনও নির্বাচনী দায়বদ্ধতা নেই। এই সুযোগ আর না-ও মিলতে পারে। শিল্পমহল থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদরা পর্যন্ত তাই একে শুধু হিসেবনিকেশের বাজেট হিসেবে দেখছেন না। বরং দেখতে চাইছেন সরকারের আগামী দিনের দিশা নির্দেশ, তারা কোন পথে চলবে, তার নীল নকশা হিসেবে। লগ্নিকারীরা আবার বাজেটকে বেসরকারি বিনিয়োগ ও যৌথ উদ্যোগের জন্য স্থায়ী নীতি ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের সংস্কার হিসেবে দেখতে চান। তাঁদের যুক্তি, স্থায়ী নীতি তৈরি হলেই প্রধানমন্ত্রীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি সফল হবে। তাই তাঁরা পরিকাঠামোয় বড় মাপের লগ্নি চান।
গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর সাফল্যের পিছনে ‘মোদীনমিক্স’-এর মূল মন্ত্র ছিল, বেসরকারি লগ্নি নিয়ে এসে আর্থিক উন্নয়ন। রাজধানীতে এসে তাঁর সামনে সমস্যা হল, বেসরকারি বিনিয়োগ আসছে না। বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি শেয়ার বাজারে টাকা ঢাললেও কারখানা তৈরির জন্য লগ্নি আসছে না। এই অবস্থায় বৃদ্ধির হারকে টেনে তুলতে একমাত্র উপায় পরিকাঠামোয় ও শিল্পে সরকারি বিনিয়োগ, যাতে বেসরকারি শিল্পও লগ্নিতে উৎসাহিত হয়।
কিন্তু সরকারি বিনিয়োগের টাকা আসবে কোথা থেকে? একটা মত হল এই যে, অশোধিত তেলের দাম কমে যাওয়া এবং তেলের উপর শুল্ক বসানোর ফলে কেন্দ্রের হাতে পরিকাঠামোয় ব্যয় করার মতো যথেষ্ট অর্থ থাকবে। কিন্তু তেলের দাম কমার ফলে কিছুটা সাশ্রয় হলেও, হিসেবনিকেশের অঙ্কে ধাক্কা খেতেই হচ্ছে জেটলিকে। সরকারি লগ্নি বাড়ালে রাজকোষ ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে। একশো দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষার মতো সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি মোদীর স্বচ্ছ ভারত, স্মার্ট সিটি, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার মতো স্বপ্নের প্রকল্পেও টাকা বরাদ্দ করতে হবে। শিল্পে উৎসাহ দিতে গিয়ে বা আম আদমির জন্য কর ছাড় দিতে গেলেও ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে। চ্যালেঞ্জ কঠিন জেনেও চলতি অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ৪.১% রেখেছিলেন মোদীর অর্থমন্ত্রী। কর বাবদ আয়ে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার
ঘাটতি থাকলেও জেটলি জানিয়েছেন, সেই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে তিনি বদ্ধপরিকর। তা হলে পরিকাঠামো তৈরির অর্থ আসবে কী করে? আগামী বছর রাজকোষ ঘাটতি কতখানি কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নেবেন জেটলি? অর্থ মন্ত্রকের উপদেষ্টা থেকে অর্থনীতিবিদ, শিল্পমহলও এ বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত।
মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন দিনকয়েক আগে বলেছিলেন, বেসরকারি লগ্নির অনুপস্থিতিতে বৃদ্ধির হারকে টেনে তুলতে সরকারি লগ্নি বাড়াতে হবে। তাতে ঘাটতির হার বাড়লে বাড়ুক। একই যুক্তি দিয়েছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর বিমল জালানও। আর্থিক শৃঙ্খলা আইন অনুযায়ী আগামী অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতির হার ৩.৬ শতাংশে কমিয়ে আনার কথা। যাঁরা বাঁধন আলগা করার পক্ষে, তাঁরা বলছেন, ঘাটতি ৩.৮ শতাংশ হলেও অসুবিধা নেই।
উল্টো যুক্তিও রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর্স, মুডি’জ-এর মতো আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি বা মূল্যায়ন সংস্থাগুলি সতর্ক করেছে, ঘাটতি লাগামছাড়া হলে ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে তারা নেতিবাচক মনোভাব নেবে। ভারতে এমনিতেই ঘাটতির হার বেশি বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ)। এইচডিএফসি ব্যাঙ্কও জানিয়েছে, আগামী অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি ৩.৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছে তারা। সদ্য প্রকাশিত অর্থনৈতিক সমীক্ষাও বলছে, ভবিষ্যতের ঝুঁকি সামলানোর জন্যই এখন রাজকোষ ঘাটতির হার যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখা ভাল।
২০০৮ সালের বিশ্ব জুড়ে মন্দার সময় দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে রাজকোষের বাঁধন আলগা করেছিলেন তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় আখেরে ক্ষতি হয় বলে অভিযোগ ওঠে। প্রণবের উত্তরসূরি পি চিদম্বরম শক্ত হাতে রাজকোষ ঘাটতিতে লাগাম পরান। তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে খরচ কমিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও অভিযোগ উঠেছিল, ঘাটতি কমাতে গিয়ে পরিকল্পনা-ব্যয়ে কোপ পড়েছে। আখেরে অর্থনীতিরই ক্ষতি হয়েছে। সরকার ভর্তুকি-বেতন-পেনশনের খরচ কমাতে পারেনি। বন্ধ হয়েছে নতুন পরিকাঠামো বা সম্পদ তৈরি।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, বাজেটে জেটলি সড়ক, বিদ্যুৎ, রেল, বন্দরের মতো পরিকাঠামো তৈরিতে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করতে পারেন। এই সব ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ আনার জন্যও আকর্ষণীয় মডেল ঘোষণা হতে পারে। অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানার মতো বড় মাপের পরিকাঠামো প্রকল্পও ঘোষণা হতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের দাবি, পরিকাঠামো তৈরিতে এ বছর সরকারি বরাদ্দ ১ লক্ষ কোটি টাকা বাড়ানো হোক। তার জন্য যদি রাজকোষ ঘাটতি ৪.১ শতাংশ থেকে এক লাফে ৩.৬ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব না হয়, না হোক। বরং রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আনার দিকে বেশি নজর দিক কেন্দ্র। সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন ও ভর্তুকির পরিমাণ বেশি হলেই রাজস্ব ঘাটতি বেশি হয়। বেতন-পেনশন হঠাৎ করে কমিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। তাই ভর্তুকির বহর কমানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত বলেই তাঁদের মত। চলতি অর্থবর্ষে রাজস্ব ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২.৯%। আগামী বছর তা ২ শতাংশে বেঁধে রাখার সব রকম চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু ভর্তুকি কমানো মানে তো অপ্রিয় হওয়া, বিশেষত শহুরে মধ্যবিত্তের কাছে। তাঁরাই সবচেয়ে সরব এবং সক্রিয় ‘আম আদমি’। অতএব অরবিন্দ কেজরীবালের জুজু আছেই।
ভয় না পেয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী দড়ির খেলাটা উতরে যেতে পারবেন কি? উত্তর মিলবে আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy