গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
দ্বিতীয় বার আরও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এনডিএ। আরও শক্তিশালী মোদী সরকার। ফলে অর্থনৈতিক সংস্কারে সাহসী পদক্ষেপের প্রত্যাশা ছিল। সঞ্চয়ে সুদের হারে ক্রমাগত পতন, মূল্যবৃদ্ধির চাপে ন্যুব্জ মধ্যবিত্তের ভার লাঘবের আশা ছিল। কিন্তু না আর্থিক সংস্কার, না মধ্যবিত্তের ঝুলিতে বড় কিছু উপহার— কোনও ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী কোনও ঘোষণা বা প্রস্তাব নেই নির্মলা সীতারামনের বাজেটে। উল্টে পেট্রোল-ডিজেলের উপর চাপানো হল সেস। যার প্রভাব পড়বে সব ক্ষেত্রে। মূল্যবৃদ্ধির গতি আরও দ্রুততর হবে। সরকারের ঢাক পেটানো হল, দেওয়া হল ৫ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হিসেবে মাথা তোলার প্রত্যাশা। বাকিটা পুরনো প্রকল্পগুলির চর্বিত চর্বন।
বাজেট প্রস্তাবে মধ্যবিত্তের প্রধান আকর্ষণ থাকে আয়করের উপর। কারণ এর প্রভাব প্রত্যক্ষ। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জন্য কোনও ঘোষণা নেই। লোকসভা ভোটের আগে অন্তর্বর্তিকালীন বাজেটে পীযূষ গয়াল এমন ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে পাঁচ লক্ষ টাকা আয় হলে কোনও কর দিতে হত না। আয়করের ক্ষেত্রে সেই ঊর্ধ্বসীমাই বজায় রাখলেন নির্মলা। শুধুমাত্র উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে আয়করের উপর সারচার্জ কিছুটা বেড়েছে। নতুন বলতে প্যান-আধার ইন্টারচেঞ্জ। অর্থাৎ প্যানের বদলে আধার নম্বর দিয়েও আয়কর রিটার্ন দাখিল করা যাবে।
জ্বালানির দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ে সর্বত্র, সমাজের সব স্তরে। শিল্প কলকারখানা থেকে বিদ্যুৎ, পরিবহণ, রেল, বিমান— সব ক্ষেত্রেই খরচ বাড়ে। অস্বস্তি বাড়িয়ে সেই পেট্রোল ডিজেলের উপর লিটারপিছু এক টাকা সেস চাপিয়েছেন সীতারামন। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম পড়তির দিকে। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় আরও কমার ইঙ্গিত রয়েছে। ফলে জ্বালানির উপর সামগ্রিক স্বস্তির যে ইঙ্গিত মিলেছিল সমীক্ষায়, তাতেও কার্যত জল ঢাললেন দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মহিলা অর্থমন্ত্রী।
মধ্যবিত্তের জন্যে এক মাত্র গৃহঋণের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছেন নির্মলা। গৃহঋণের সুদে অতিরিক্ত দেড় লক্ষ টাকা আয়কর ছাড়ের প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে। অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৪৫ লক্ষ টাকা মূল্যের বাড়ি কেনার জন্য ঋণ নিলে তার সুদের উপর দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় মিলবে। যার সুবিধা পাবেন খুব সামান্য মানুষই।
আরও পড়ুন: আয়করে তেমন কিছুই জুটল না মধ্যবিত্তের, শুধু ছাড়ের সীমা বাড়ল গৃহঋণের সুদে
ভারত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। তাই বাজেটে অর্থনীতিবিদ থেকে আমজনতার নজর থাকে কৃষিতে।নির্মলা এদিন জানিয়েছেন, বাজেটের লক্ষ্য ‘গাঁও-গরিব-কিসান’। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা, কৃষি পণ্য পরিবহণের কথা বলা হলেও তার নির্দিষ্ট কোনও দিশা নেই। বলা হয়েছে বেসরকারি বিনিয়োগের কথা। ভোটের আগের বাজেটে ঘোষণা হয়েছিল দরিদ্র কৃষকদের মাসে ৬০০ টাকা অনুদান। এ দিন সেই প্রকল্পের কথা ফের উল্লেখ করলেও অনুদানের পরিমাণ বা নতুন কোনও প্রকল্পের ঘোষণা নেই কৃষিক্ষেত্রে। সরকারি নয়, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কৃষির উন্নয়নের চেষ্টা করা হবে, আশ্বাস নির্মলার।
গ্রামীণ অর্থনীতি বা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে নয়া কোনও ঘোষণা নেই। অথচ ভারতীয় অর্থনীতিতে গ্রামের গুরুত্ব বোঝাতে ‘গ্রামেই থাকে ভারতের আত্মা’— মহাত্মা গাঁধীর এই উদ্ধৃতি বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন সীতারামন। গ্রামাঞ্চলে কত বাড়ি তৈরি হয়েছে, কত শৌচালয় তৈরি হয়েছে, কত সংখ্যক বাড়িতে বিদ্যুৎ-গ্যাস পৌঁছেছে, তার খতিয়ান তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। এই অর্থবর্ষে এবং আগামী পাঁচ বছরে এই সব প্রকল্পে লক্ষ্যমাত্রা কত, তারও একটা রূপরেখা দিয়েছেন। কিন্তু ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’, ‘স্বচ্ছ ভারত মিশন’ ‘উজ্জ্বলা যোজনা’ সবই পুরনো। ‘ভারতের আত্মা’র উত্তরণে নতুন কোনও প্রকল্প বা পরিকল্পনার দিশা নেই বাজেটে।
আরও পড়ুন: নোটবন্দির ধাক্কা সামলাতে গাঁজা-আফিমের চাষ করছে মাওবাদীরা!
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘নারীর উন্নতি ছাড়া বিশ্বের উন্নয়ন সম্ভব নয়’। নির্মলার বক্তব্যে সেই উদ্ধৃতি ছিল। ‘নারী তু নারায়ণী’ স্লোগান ছিল। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা এবং গুরুত্বও বুঝিয়েছেন নির্মলা। এই ক্ষেত্রে স্বনির্ভর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক মহিলা জন ধন অ্যাকাউন্ট থেকে ৫০০০ টাকা ওভারড্রাফট নিতে পারবেন। এছাড়া ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন তাঁরা। এর বাইরে নারী ক্ষমতায়নেও উজ্জ্বলা যোজনায় গ্যাস, স্বচ্ছ ভারত মিশনে শৌচালয় তৈরি করা কিংবা বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ দেওয়াকেই বোঝাতে চেয়েছেন নির্মলা।
ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে গতি আনতে সরকারি অনুদানের পক্ষেই হাঁটলেন সীতারামন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ঘাড়ে বিপুল পরিমাণ নন পারফর্মিং অ্যাসেট বা অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা। যদিও অর্থমন্ত্রীর দাবি, অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ কমছে। সেই ভার লাঘব করতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে মোট ৭০ হাজার কোটি টাকা সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর ফলে ব্যাঙ্কগুলির ঋণ দানের ক্ষমতা বাড়বে বলে মত নির্মলার। এ ছাড়া হাউসিং ফিনান্স কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ হাউসিং বোর্ডের হাত থেকে যাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে।
সড়ক-সহ যাবতীয় পরিকাঠামো উন্নয়নে আগামী পাঁচ বছরে সরকারের প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১০০ লক্ষ কোটি টাকা। রেল ও মেট্রোর পরিকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। বিমা ক্ষেত্রে খুলে দেওয়া হয়েছে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের রাস্তা। তার সুফল এবং কুফল দু’টিই আছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং বিশেষ করে স্টার্ট আপের ক্ষেত্রে কিছুটা আশার খবর শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এক মিনিটে ঋণ মঞ্জুর-সহ আয়কর এবং বিনিয়োগে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হবে। এছাড়া দূরদর্শনে শুধুমাত্র স্টার্ট আপের কথা মাথায় রেখেই একটি অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বাজেটে। কর্পোরেট ট্যাক্সেও বেশ কিছু নিয়ম শিথিল করা এবং ছাড়ের প্রস্তাব রয়েছে।
পরিবেশ সহায়ক বলে ব্যাটারিচালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছেন নির্মলা সীতারামন। এই প্রযুক্তির গাড়ি কিনলে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছেন নির্মলা সীতারামন। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুৎ এবং সৌর আলো ব্যবহারেও জোর দেওয়া হয়েছে। সৌরশক্তিচালিত পণ্যের উপর বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা রয়েছে বাজেটে।
নোট বাতিল নিয়ে কার্যত মুখ পুড়েছিল প্রথম মোদী সরকারের। নোটবন্দির ফলে না অর্থনীতির হাল ফিরেছে, না কালো টাকা ফিরেছে— জানিয়ে দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। সেই নোটবন্দির পর নতুন রূপে প্রায় সব রকমের নতুন নোট এসেছে। এ বার ২০ টাকার কয়েন আসছে। সেই সঙ্গে প্রচলিত কয়েনগুলিও নতুন রূপে আসছে বলে বাজেটে জানানো হয়েছে।
অর্থাৎ মোটের উপর বাজেটে বিরাট কোনও ব্যাতিক্রমী ঘোষণা নেই বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অথচ মোদী সরকারের হাতে সুযোগ ছিল। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা সরাকারের হাতে পাঁচ বছর সময় ছিল। কিন্তু আর্থিক সংস্কারের কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। তাঁদের মতে, ৫ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হিসেবে ভারতকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যের কথা শোনানো হয়েছে বটে, কিন্তু সেই স্তরে পৌঁছতে যে দিশা বা নিবিড় ও সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার হয়, তার কোনও দিশা নেই। আর্থিক বৃদ্ধির হার দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে ৮ শতাংশের উপরে রাখতে হবে। প্রভূত উন্নতি ঘটাতে হবে পরিকাঠামো, পরিবহণ, শিল্প, বিনিয়োগ, বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে সব ক্ষেত্রে।
বিরোধীদের অভিযোগ, দিশাহীন ও প্রতারণার বাজেট। মানুষ যে ভাবে এনডিএ-কে উজাড় করে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে দ্বিতীয় মোদী সরকার। আম জনতার জন্য কার্যত কোনও উল্লেখযোগ্য ঘোষণা নেই। পুরনো প্রকল্পগুলিই বারবার করে আওড়ানো হয়েছে। অর্থনীতিকে মজবুত ভিতের উপর দাঁড় করাতে কোনও দিশা না দেখিয়ে ঝোলানো হয়েছে ৫ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতির গাজর।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy