Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

সারদা-তোপ বিজেপির, দিশাহারা তৃণমূল

গত কাল মাথায় ছিল কালো ছাতা। আজ জুটল মুখে কালি। কালো টাকা নিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে ‘খোঁচা দিতে’ সংসদে ছাতা আনার ভাবনাটা ছিল খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই লোকসভাতেই সারদা নিয়ে বিজেপি সাংসদ অনুরাগ ঠাকুরের এমন গোলাবর্ষণের মুখে পড়ল মমতা-বাহিনী, যে পারলে আজও তারা ছাতার আড়াল খোঁজেন! মমতা নিজে, মদন মিত্র, কুণাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসু, আহমেদ হাসান ইমরান থেকে শতাব্দী রায় কাউকেই রেহাই দিলেন না হিমাচলের তরুণ সাংসদ অনুরাগ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৩৯
Share: Save:

গত কাল মাথায় ছিল কালো ছাতা। আজ জুটল মুখে কালি।

কালো টাকা নিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে ‘খোঁচা দিতে’ সংসদে ছাতা আনার ভাবনাটা ছিল খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই লোকসভাতেই সারদা নিয়ে বিজেপি সাংসদ অনুরাগ ঠাকুরের এমন গোলাবর্ষণের মুখে পড়ল মমতা-বাহিনী, যে পারলে আজও তারা ছাতার আড়াল খোঁজেন! মমতা নিজে, মদন মিত্র, কুণাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসু, আহমেদ হাসান ইমরান থেকে শতাব্দী রায় কাউকেই রেহাই দিলেন না হিমাচলের তরুণ সাংসদ অনুরাগ। বললেন, ‘‘যারা পশ্চিমবঙ্গে কালো টাকা কামিয়েছে, তারাই আজ কালো ছাতা নিয়ে নেমেছে। এ তো চোর উল্টে দারোগাকে ধমকাচ্ছে।” দেশদ্রোহের অভিযোগ পর্যন্ত তুললেন তিনি। আর সরাসরি টিভি সম্প্রচারে গোটা দেশ দেখল, কার্যত মুখ বুজে অনুরাগের তোপ হজম করছেন তৃণমূল সাংসদরা। পিসিকে যখন নিশানা করা হচ্ছে, তখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একটু গলা তুলেছিলেন। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ের মতো দু’একজন কিছু বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই।

আসলে বিসিসিআইয়ের যুগ্মসচিব অনুরাগ যে এমন আগুনে স্পেল করবেন, আঁচই করতে পারেনি তৃণমূল। অনুরাগ যখন শুরু করেন, তখনও তৃণমূল সাংসদরা কালো টাকা নিয়ে ইতস্তত মন্তব্য করছিলেন। অনুরাগ বলেন, “কালো টাকা নিয়ে যখন আলোচনা, সারদা নিয়ে কথা না হলে গল্পটাই অসমাপ্ত থেকে যাবে।... বিদেশি কালো টাকার পাশাপাশি একটু দেশি কালো টাকা নিয়েও আলোচনা হোক।” সেই যে ‘আলোচনা’ শুরু হল, তৃণমূল সাংসদরা অপেক্ষা করছিল, অনুরাগ কখন ‘সুইস ব্যাঙ্কে’ ফেরেন। কিন্তু তিনি কার্যত গোটা সারদা-কাণ্ড বর্ণনা করেই ছাড়েন।

প্রথমেই অনুরাগ প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “আপনাদের রাজ্যসভার দুই সাংসদ কোথায়? কুণাল ঘোষ নিজেই বলছেন, তিনি ছোট খেলোয়াড়। আসল ক্ষীর খেয়েছে আরও বড় কেউ। কুণাল সারদার মিডিয়ায় ১৫ লক্ষ টাকা বেতন পেতেন। এর পরে যে কেউ সারদার হয়ে ঢাক পেটাবে।” একই ভাবে সৃঞ্জয় বসুর সঙ্গেও সারদার চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনুরাগ। এর পর আসে মদন মিত্রের প্রসঙ্গ। অনুরাগ বলেন, “মদন মিত্র সাহেব সারদার কর্মী ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। চিৎকার করে তিনি বলেছেন, সবাই এই কোম্পানিতে টাকা রাখুন।”

মদনের পরে মমতা! অনুরাগ বলে চলেন, “সুদীপ্ত সেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা দামের পেন্টিং! তাঁর ছবি কি এত টাকায় আগে বিক্রি হয়েছিল? না হয়ে থাকলে সুদীপ্ত কেন এত টাকা দিয়ে ওই ছবি কিনলেন?” এই জন্যই মমতা সমস্ত পাঠাগারে সারদার সংবাদপত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না, প্রশ্ন তোলেন অনুরাগ। বলেন, “আপনাদের সাংসদরা সারদার সংস্থা থেকে মোটা বেতন পাচ্ছে। আর এক মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কারখানাও সুদীপ্ত সেন কিনেছিলেন। আর আপনারা দিল্লিতে এসে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন!” অনুরাগ দাবি করেন, ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসের কুশীলবদের সাহায্য করার জন্য দেশবাসীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে তৃণমূলকে। এক ধাপ এগিয়ে তিনি বলেন, “তৃণমূলের আর এক সাংসদ জামাত-ই-ইসলামিকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। ইনিও সারদার সঙ্গে জড়িত। নামটা আপনারা বলবেন, না আমিই বলে দেব?”

তৃণমূল সাংসদরা এই সময়ে আপত্তি তোলেন, রাজ্যসভার সাংসদদের নাম কেন লোকসভায় টানা হচ্ছে? অনুরাগকে তখনই সিপিএমের মহম্মদ সেলিম বলেন, সারদা কাণ্ডে লোকসভার সাংসদদের নামও উঠে এসেছে। তাঁদের নামই তোলা হোক। তাৎপর্যপূর্ণ যে, গত কাল তৃণমূলের হইহল্লার সময়ে কালো টাকা নিয়ে আলোচনার দাবি তুলেছিল সিপিএম। এমনকী সপা-কংগ্রেসও গলা মিলিয়েছিল। কিন্তু আজ তৃণমূল দেখে, পাশে নেই কেউ!

অনুরাগ তোপ দাগেন, “ওঁদের লোকসভার এক সাংসদ সারদার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন। বলুন ছিলেন কি না?” বিজেপির সকলে সুর মেলান, “ছিলেন, ছিলেন।” লক্ষ্য যিনি, সেই শতাব্দী রায় অবশ্য এই সময়ে লোকসভায় ছিলেন না। সারদাকে ‘দেশের সব থেকে বড় কেলেঙ্কারি’ আখ্যা দিয়ে অনুরাগ বলেন, “আপনারা সংসদে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সব তথ্য পেশ করুন। সেটাই হবে দেশভক্তির পরিচয়।”

কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতাই যে সুদীপ্ত সেনকে গ্রেফতার করিয়েছেন, সে কথা মনে করিয়ে তিনি বলেন, “সারদা নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে আপনারা নোটিস দিন। আমরা রাজি। (যদিও রাজ্য বিধানসভায় কখনও সারদা নিয়ে আলোচনায় রাজি হতে দেখা যায়নি তৃণমূলকে।)” সুদীপ নেমে পড়েন মোদী-মমতা তুলনায়। কখনও বলেন, গুজরাতে মোদীর চেয়েও বাংলায় মমতার জনপ্রিয়তা বেশি। কখনও আবার বলেন, গুজরাতে বিজেপি যত আসন পেয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল তার থেকেও বেশি আসন জিতেছে। এ-ও দাবি করেন, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল দু’শোর বেশি আসন জিতবে। ও দিকে, রাজ্যসভায় তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন গত কালের সুরেই আক্রমণ জারি রাখেন। তিনি বলেন, ভোটের আগে মোদী কালো টাকা ফেরত আনার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ফলে এ বার সংসদে তাঁর সরকার ক্ষমা চাক। “আপনারা তো কোনও কথাই রাখছেন না,” বলেছেন তিনি।

দিনভর চর্চার কেন্দ্রে অবশ্য অনুরাগ ও বিব্রত তৃণমূল নেতারা। কলকাতায় রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিংহ রোজই তৃণমূলকে আক্রমণ করেন। কিন্তু দিল্লি থেকে, তা-ও আবার সংসদে বিজেপির এ হেন তৃণমূল-নিশানা অভূতপূর্ব।

বিরোধীদের মতে, সারদা-খাগড়াগড় নিয়ে বেকায়দায় পড়েই পাল্টা চাপ দিতে কালো টাকা নিয়ে হইহল্লা শুরু করে তৃণমূল। কিন্তু বিজেপি তাদের মোকাবিলা করেছে মমতারই অস্ত্রে। সংসদে রাজ্য রাজনীতির বিষয় তুলে আনা মমতারই পুরনো কৌশল। বাম জমানায় তৃণমূল সাংসদরা পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে সংসদে সরব হতেন। অনুরাগ সেই তাসটাই খেলেছেন।

আর গোটাটার পিছনেই রয়েছে সুচিন্তিত পরিকল্পনা। বিজেপি সূত্রের খবর, তৃণমূলকে ছেড়ে কথা বলা চলবে না বলে সাফ নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সভাপতি অমিত শাহ। তার পর অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নায়ডুর সঙ্গে আলোচনা করেই অনুরাগ ময়দানে নেমেছেন। যা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে দ্বৈরথ আরও বাড়তে চলেছে দু’দলের।

আজ অধিবেশনের শুরুতেই ছাতা-বিক্ষোভ নিয়ে স্পিকারের কাছে ধমক খায় তৃণমূল। স্পিকার সুমিত্রা মহাজন বলেন, এর জন্য সাংসদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকলেও তিনি তেমন কিছু করছেন না। তৃ

দিনের শেষে তৃণমূলের এক সাংসদ বললেন, “যেমন কর্ম, তেমন ফল। কালো টাকা নিয়ে বিজেপিকে খোঁচাতে গিয়েছিলাম। সারদা নিয়ে পাল্টা খোঁচা খেতেই হতো।” বেঙ্কাইয়া নায়ডুর সরস মন্তব্য, “আজ নিজেদের গোলেই বল ঠেলে দিয়েছে তৃণমূল!”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE