মুক্তির পর বিলকিস বানো মামলায় অপরাধীদের মিষ্টিমুখ। ফাইল চিত্র।
সুআচার-ব্যবহারই বিলকিস বানো মামলায় ১১ জন অপরাধীকে আগেভাগে মুক্তি দেওয়ার অন্যতম কারণ বলে আদালতে জানিয়েছে গুজরাত সরকার। বাস্তবের তথ্যপ্রমাণ কিন্তু উল্টো কথাই বলছে।
এই ১১ জন যখন বিভিন্ন সময় প্যারোলে জেলের বাইরে ছিল, তাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠেছে। দু’জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে। দু’জনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জমা পড়েছে। ১১ জনের মধ্যে ১০ জনই প্যারোলের নিয়মভঙ্গ করেছে। নিয়মভঙ্গের জন্য বেশ কয়েক জন জেলে শাস্তিও পেয়েছে। এই সব তথ্য জানা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়া গুজরাত সরকারের হলফনামা থেকেই। অপরাধীদের মুক্তির বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা হয়েছে, সেখানে বিচারপতিরা গুজরাত সরকারের কাছে নথিপত্র চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেখানেই দেখা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও অপরাধীদের মুক্তিতে সায় দিয়েছিল। কিন্তু যে ‘সুআচার-ব্যবহারে’র যুক্তি দেখিয়ে সেই মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তার ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে সরকারের জমা দেওয়া নথি খতিয়ে দেখলে।
যেমন, রাধেশ্যাম শাহ এবং মিতেশভাই ভাট। দাহোদের রাধিকাপুর থানায় এই দু’জনের নামে এফআইআর হয়েছে ২০২০ সালের জুলাই মাসে। এফআইআর করেছেন সবেরাবেন পটেল এবং পিন্টুভাই। পিন্টুভাই বিলকিস মামলার অন্যতম সাক্ষী। যৌন হয়রানি, শাসানি, খুনের হুমকির মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছেন তাঁরা।
বিলকিস মামলার সাক্ষী মানসুরি আব্দুল রাজ্জাক আব্দুল মাজিদ ২০১২-এর জানুয়ারি মাসে দাহোদ পুলিশের কাছেই অভিযোগ করেছেন আর এক অপরাধী শৈলেশ চিমনলাল ভাটের বিরুদ্ধে। এখানেও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ। কিন্তু এফআইআর হয়নি।
ঘাঞ্চি আদমভাই ইসমাইলভাই এবং ঘাঞ্চি ইমতিয়াজভাই ইউসুফভাই— বিলকিস মামলার আরও দুই সাক্ষী। তাঁরা দাহোদ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন গোবিন্দ নাইয়ের নামে। খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ। তবুও এফআইআর হয়নি।
মুক্তি পাওয়া ১১ জন অপরাধী ১৪ বছরেরও বেশি জেলে থেকেছে বলে জানিয়েছে গুজরাত সরকার। কিন্তু নথি বলছে, তারা প্রায় সকলেই হাজার দিনেরও বেশি প্যারোলে থাকার সুযোগ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ১১ জনের মধ্যে ১০ জনই প্যারোলের নিয়মভঙ্গ করে নির্দিষ্ট দিনের চেয়ে অনেক দেরিতে জেলে ফিরেছে। ১০ দিন বা তার কম দেরি হলে তাদের সাবধান করা হয়েছে, কখনও এক মাসের জন্য ক্যান্টিনের সুবিধা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি দেরি করলে ‘আর্নড রেমিশন’-এর সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের সাজাপ্রাপ্তরা জেলে নিয়মানুবর্তিতা পালনের বিনিময়ে মুক্তি এগিয়ে আনার সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাকেই আর্নড রেমিশন বলা হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রাজুভাই বাবুলাল সোনি ২০১৫ সালে ১৯৭ দিন দেরিতে ফিরে ‘আর্নড রেমিশন’-এর সুবিধা হারিয়েছে। যশবন্তভাই চতুরভাই রাওয়াল ৭৫ দিন দেরিতে ফিরে ৩৭৫ দিনের জন্য আর্নড রেমিশন খুইয়েছে। অর্থাৎ জেলেও নিয়মভঙ্গের জন্য শাস্তি পাওয়ার নজির রয়েছে এই অপরাধীদের। অথচ সেগুলো দৃশ্যতই তাদের ‘সুআচার’ প্রমাণে কোনও বাধা হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট নিজেও গুজরাত সরকারের হলফনামা দেখে মন্তব্য করেছে, ‘‘প্রচুর কাগজপত্র। কিন্তু বক্তব্যের সমর্থনে তথ্যপ্রমাণ কোথায়?’’
আইন বিশেষজ্ঞরা আরও প্রশ্ন তুলছেন, গুজরাত সরকার এই মুক্তির সিদ্ধান্তের পিছনে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনামার কথা বলেছে। কিন্তু ওই নির্দেশনামার শর্ত তারা পূরণ করেছে কি? ১৯৯২-এর যে আইন-বলে সুপ্রিম কোর্ট পূর্বমুক্তির কথা বিবেচনা করতে বলেছিল, সেখানে নির্দিষ্ট কিছু শর্তও রাখা হয়েছিল। অপরাধীরা মুক্তি পেলে সমাজে তার কী প্রভাব পড়বে, অপরাধীদের মধ্যে ফের অপরাধ করার সম্ভাবনা রয়েছে কি না, খতিয়ে দেখার কথা ছিল। যে আদালত তাদের দোষী সাব্যস্ত করেছে, সেই আদালতের মত নেওয়ার কথা ছিল। আদালতের মত না মানলে তার কারণ দর্শানোর কথা ছিল। বিলকিস মামলার ক্ষেত্রে দেখাই যাচ্ছে, অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল নিম্ন আদালত, সিবিআই, এমনকি দাহোদ পুলিশও। গুজরাত সরকার কর্ণপাত করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারও না। সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার অন্যতম আবেদনকারী, তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র এ দিন কটাক্ষ করে টুইট করেছেন, ‘‘গুজরাত নির্বাচনে বিজেপির ইস্তাহারের প্রথম প্রতিশ্রুতি— জাতীয় ছুটির দিন দেখে ‘সংস্কারী’ ধর্ষক আর খুনিদেরমুক্তিদান!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy