Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
অযোধ্যা সে দিন

অনর্থ হো জায়েগা, বলল বান্টি

অনর্থ তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। যে বিতর্কিত কাঠামোটিকে কেন্দ্র করে অযোধ্যায় এই আসা-যাওয়া, তার উপরে-নীচে, ডাইনে-বামে, সামনে-পিছনে তখন থিকথিক করছে হাজার হাজার ‘বান্টি’।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

দেবব্রত ঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:৫০
Share: Save:

বান্টি এখন প্রায় প্রৌঢ়। ২৮ বছর আগে, ১৯৯১ সালে আলাপ হয়েছিল ওর সঙ্গে। অযোধ্যায়। বজরং দলের সদস্য, বছর ২৩-২৪ এর রাগী যুবক। প্রথম আলাপে বলেছিল, ‘বোল্, জয় শ্রীরাম! আবে বোল্।’ সরযূর ও পারে সুলতানপুর জেলার কোনও গ্রামে ওর বাড়ি। যখনই রামজন্মভূমির উদগাতারা ডাক দিয়েছেন, বান্টি অযোধ্যায় হাজির হয়েছে। এক বারও মিস্ নেই। ৯১-৯২, বছর দুয়েকে বহু বার অযোধ্যা যাতায়াতে প্রায় বন্ধুত্ব। করসেবকদের ভিতরের খবর-টবর বলে। কিন্তু সে দিন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের দুপুরে সেই বান্টিই বাঁশ হাতে তেড়ে এল, ‘ভাগ যাইয়ে দাদা। নেহি তো অনর্থ্ হো জায়গা।’

অনর্থ তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। যে বিতর্কিত কাঠামোটিকে কেন্দ্র করে অযোধ্যায় এই আসা-যাওয়া, তার উপরে-নীচে, ডাইনে-বামে, সামনে-পিছনে তখন থিকথিক করছে হাজার হাজার ‘বান্টি’। ও পাশে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অস্থায়ী অফিস থেকে তখন ভেসে আসছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ অশোক সিঙ্ঘলের গলা। করসেবকদের জন্য অনুশাসন-বাহী বার্তা, ‘শান্ত রহিয়ে’, ‘আপকা করসেবা হো গিয়া, অব উতর আইয়ে’ কিংবা ‘রাম কা নাম বদনাম মৎ কিজিয়ে’ গোছের সতর্ক-বার্তা।

কিসের সতর্কতা। উন্মত্ত করসেবকরা বিতর্কিত কাঠামোর বাইরের দিকের লোহার পাইপের বেড়া, লোহার বড় বড় অ্যাঙ্গল ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। সেই লোহার টুকরোই তাদের হাতিয়ার। তার আঘাতে একে একে ধসে পড়েছে ভিতর-বাইরের তিন-চার ফুট চওড়া দেওয়াল। কয়েকশো বছর আগে তৈরি সেই দেওয়ালে ইট তো গাঁথা হয়েছে মাটি দিয়ে। কড়ি-বরগার উপরে শুধু ছাদ আর তিনটি গম্বুজ চুন-সুরকির ঢালাই। সেটাই যা শক্ত-পোক্ত। তথাকথিত গর্ভগৃহের থামও লাগাতার আঘাতে জর্জরিত। প্রথম আধ ঘণ্টা গম্বুজে আঘাত হেনেও তাকে বাগে আনতে পারেনি করসেবকরা। এ বারগম্বুজ আর ছাদের ‘জোড়’-এ পড়তে লাগল মূল চক্রী, অন্ধ্র থেকে আসা ‘সশস্ত্র’ দলটির শাবল-গাঁইতি।

অযোধ্যা মামলা সম্পর্কে এই তথ্যগুলো জানেন?

আরও পড়ুন: অযোধ্যা মামলার রায় আজ

ও দিকে মাইকে তখন সিঙ্ঘল, বিনয় কাটিয়ার, রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়া থেকে শুরু করে লালকৃষ্ণ আডবাণী বলে চলেছেন, ‘‘যাঁরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন, তাঁরা আমাদের লোক নয়। করসেবা ভন্ডুল করতে আসা ষড়যন্ত্রী। পিভি, মুলায়ম, ভিপির পাঠানো লোক। তাদের কোনও প্ররোচনায় করসেবকরা পা দেবেন না।’’ লাগাতার সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করে ভেঙে পড়ল প্রথম গম্বুজটি। ঘড়িতে তখন ১২টা ৩০ মিনিট।

১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর ধ্বংসলীলার আগে এখানেই ছিল সেই বিতর্কিত কাঠামো, রাম চবুতরা, কীর্তন চবুতরা, সিংহদ্বার প্রভৃতি।

কাঠামো লাগোয়া বাড়ি ‘সীতা রসুই’-এর ছাদে দাঁড়িয়ে তখন সেই ধ্বংসলীলা দেখতে দেখতেই কয়েক জন সাংবাদিক বার বার তাকাচ্ছেন পিছনের রাস্তার দিকে। ওই বুঝি এল প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওয়ের পাঠানো সেনা, আধা-সেনার দল! পাঁচ কিলোমিটার দূরে, ফৈজাবাদেই তো সেনা ছাউনি। আগাম সতর্কতা হিসেবে গত দশ দিন ধরে ছাউনি গেড়ে রয়েছে সিআরপিএফ। সিআরপিএফের প্রথম র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (র‌্যাফ)। বাহিনী এলে রক্ত গঙ্গা বইবে, তেমন আলোচনাও চলছে।

তবে প্রতীক্ষাই সার। বিনা বাধায় বেলা তিনটে নাগাদ সশব্দে ভেঙে পড়ল, ডান দিকের দ্বিতীয় গম্বুজটি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফের গলা ঝাড়া দিল রামকথা কুঞ্জের মাইক। এ বার আর সতর্কবার্তা নয়। ক্যাডার-করসেবকদের উপরে ‘আস্থা’ প্রকাশ করে লিডাররা নতুন স্লোগান তুললেন। সিঙ্ঘল, আডবাণী বা রাজমাতা নন, ভেসে এল জ্বালাময়ী ভাষণের জন্য বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) সাধ্বী ঋতম্ভরা ও উমা ভারতীয় গলা। এত ক্ষণের ‘স্টান্স’ পাল্টে ফেলে হিন্দুত্ববাদের নেতা-নেত্রীরা এ বার স্লোগান তুললেন, ‘‘এক ধাক্কা অউর দো/বাবরি মসজিদ তোড় দো।’’

নেতারা ভেসে গেলেন ক্যাডারদের স্রোতে। মুহূর্তে সেই স্লোগান ছড়িয়ে গেল করসেবকদের মধ্যে। রামভূমিতে মরাঠি করসেবকরা আওয়াজ তুললেন, ‘হর হর মহাদেও’। বিকেল ৪টে ৪৯ মিনিটে সব শেষ। ভেঙে পড়ল মাঝের মূল গম্বুজটিও। নেতাদের মাইক ও করসেবকদের গলায় গগনভেদী উল্লাস।

শীতের সন্ধ্যা দ্রুত নামছে। ফৈজাবাদে ফিরতে হবে। সকালে যে গাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, গোলমাল শুরু হতেই সে পালিয়েছে। স্থানীয় মহিলা সাংবাদিকদের ভ্যানের ডিকিই ভরসা। মোবাইল-ইন্টারনেট তখন নেই। দেশের খবর জানি না। তবে ফেরার পাঁচ কিলোমিটার পথের কোথাও বাড়ি জ্বলছে, কোথাও দোকান। গলির মুখে মুখে জটলা। আর রাস্তায় চলছে সেনা, আধা-সেনার টহল।

কার ঘর পুড়ছে কে জানে!

অন্য বিষয়গুলি:

Ayodhya Case Babri Masjid Ram Janmabhoomi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy