কামালুদ্দিন আহমদ
বর্তমান অসম রাজ্যে সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত ব্যাপারটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জির নবায়ন প্রক্রিয়াজনিত সমস্যা। রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জি বলতে এমন এক জাতীয় দলিল বোঝায় যাতে ভারতীয় নাগরিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকে। ১৯৫১ সালে দশকান্তিক লোক গণনার পর অসমে নাগরিক পঞ্জি প্রস্তুত করা হয়েছিল। এই নাগরিক পঞ্জির নবায়নের অর্থ হচ্ছে ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জির পরবর্তী কালে জাত ও নাগরিকত্ব অর্জনকারীর নাম অন্তর্ভুক্তিকরণ। নাগরিক পঞ্জি নবায়নের বিষয়টি ছিল ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার, অসম সরকার ও অসম আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে তথাকথিত অসম চুক্তি স্বাক্ষরকালে গৃহীত অন্যতম সিদ্ধান্ত। অর্ধশতাব্দী কাল ধরে অসমের রাজনীতিতে অবৈধ বাংলাদেশি প্রব্রজনকারী প্রশ্নটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও আবেগতাড়িত সমস্যা। অসম আন্দোলনের নেতাদের ভিত্তিহীন উদ্ভাবন, অসমের এক রাজ্যপাল এস কে সিংহের অভিনব অনুপ্রবেশ-তত্ত্ব প্রভৃতির ফলে অসমে এক শ্রেণির নাগরিকের মধ্যে এমন একটি বিশ্বাস প্রোথিত হয়েছে যে, অসমে কম পক্ষে নব্বই লক্ষ অবৈধ প্রব্রজনকারী বিচরণ করে অবাধে প্রজননক্রিয়া চালিয়ে সংখ্যাবৃদ্ধি করে চলেছে। অনেকের দৃঢ় প্রত্যয়, এই রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জির নবায়নের ফলে অনুপ্রবেশকারীরা চিহ্নিত হয়ে যাবে এবং তাদের বহিষ্কার সহজ হবে। অর্ধ শতাব্দীব্যাপী সংঘটিত রক্তাক্ত আন্দোলনের অবসান ঘটবে।
নাগরিক পঞ্জি ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন ও ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব রুলের শর্তানুযায়ী সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০০৫ সালের ৫ মার্চ ভারত সরকার, অসম সরকার এবং অসম ছাত্রসংস্থার নেতাদের মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়। এই বৈঠকের পর ২০০৯ সালের ৯ নভেম্বর ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জি নবায়নের জন্য অধ্যাদেশ জারি করে। ওই অধ্যাদেশ-বলে ২০০৩-এর নাগরিকত্ব রুলের অধীন নবায়ন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে প্রত্যেক নাগরিককেই স্বীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ফলে এক জন নাগরিককে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১৯৫১ সালের রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জি বা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যবাত্রি পর্যন্ত কোন ভোটার তালিকায় তার নাম আছে, বা তার পূর্বপুরুষের নাম আছে, তা প্রমাণ করতে হবে। আর এই দু’টি প্রধান দলিলে যাদের নাম থাকবে না, তাদের প্রমাণ করতে হবে অসম সরকার ও অসম ছাত্র সংস্থা-সহ অন্য জাতীয়তাবাদী দল কর্তৃক স্বীকৃত এবং সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সমর্থিত তালিকায় উল্লেখিত বিভিন্ন দলিলে তাদের নাম বা তাদের পূর্বপুরুষদের নাম আছে। এর ফলে অসমের নবায়িত রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জিতে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে তাদের মোটামুটি ৬টি শ্রেণিতে গণ্য করা যায়—
১) ১৯৫১ সালের রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জিতে যাদের নাম আছে।
২) ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ (মধ্যরাত্রি) পর্যন্ত ভোটার তালিকায় যাদের নাম আছে।
৩) উপরিউক্তদের বংশধর।
৪) যে সকল ব্যক্তি পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে অসমে এসেছেন এবং ১৯৭১ সালের পূর্বে নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন অথবা উদ্বাস্তু হিসেবে নথিভুক্ত আছেন অথবা বিদেশি শনাক্তকরণ আদালত কর্তৃক ভারতীয় বলে ঘোষিত হয়েছেন, তারা এবং তাদের বংশধরেরা।
৫) যে সকল ব্যক্তির কাছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বের কোনও বৈধ দলিল (সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত ) আছে।
৬) অসমের আদি বাসিন্দা—যাদের ভারতীয় নাগরিকত্বের কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
এই বিভাজন থেকে সহজেই বোঝা যায়, ৬ নম্বর শ্রেণিভুক্ত ছাড়া অন্য শ্রেণির জনগণের নাগরিকত্ব সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। তথাপি আপাতদৃষ্টিতে এই প্রক্রিয়াটি কিছুটা আকর্ষণীয় বলেই মনে হয়। প্রথমত প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে চলেছে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে। সুতরাং রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি দ্বারা মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হবে না। আর প্রক্রিয়াটি শেষ হয়ে গেলেই তো এ রাজ্যে বসবাসকারী নাগরিকরা নাগরিকত্বের পরিচয় লাভ করবেন এবং বসবাসের অঞ্চল, বসবাসের ইতিহাস, ও ভাষিক পরিচয়নির্বিশেষে আসামের মুসলিম জনগণকে যে অনুপ্রবেশকারী বলে অভিযুক্ত করা হয়, তা থেকে তারা মুক্তিলাভ করবেন চিরতরে। এর পরে যদি কিছু লোক অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় তাদের প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা অবলম্বনই কাম্য হবে।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার। ১৯৫১ সালের রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জি যে সরকারি ভাবে এখনও তৈরি হচ্ছে— তার প্রমাণ তো আমার নিজের লিগ্যাসি ডেটা। আমার জন্ম ১৯৪১ সালে। তদানীন্তন অসমের সিলেট জেলার করিমগঞ্জ থানার মুদ্রাকান্তি গ্রামে। অর্থাৎ বর্তমান অসমের করিমগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার মুদ্রাকান্তি গ্রামে। তাই ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জিতে আমার নাম থাকার কথা। আমি সরকার অনুমোদিত কেন্দ্র থেকে আমার রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জি বের করতে গিয়ে দেখলাম আমার নাম ঠিকানা সবই আছে। কিন্তু বাবার নামের জায়গাটা শূন্য। আমার লিগ্যাসি ডেটা কোড ২৫০-০০১৬ -৭১১১ আব্দুল করিম নামে যে আমার একজন বাবা ছিলেন, তার নামটা নেই কেন? জিজ্ঞেস করায় তারা আমার নামের সঙ্গে বাবার নাম জুড়ে দিয়ে আবার সার্চ করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে আবার একটি লিগ্যাসি ডেটা বেরিয়ে এল, সবই ঠিক আছে। বাবার নাম, গ্রাম সবই ঠিক আছে। তবে এটা আবার থানার নাম রামকৃষ্ণনগর। ১৯৫০ সালের পূর্বে করিমগঞ্জ মহকুমায় এই নামে থানা ছিল না। ১৯৫২ সালে করিমগঞ্জে যখন এনইএস ব্লক প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এই স্থানে তা প্রতিষ্ঠা করে নাম রাখা হয়েছিল রামকৃষ্ণনগর। এই স্থানে থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০০ সলে। শেষোক্ত লিগ্যাসি ডেটা কোড আগের থেকে ভিন্ন—২৫০-০০২৫-৭৮৫৯।
তাই বলছিলাম, ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জি এখনও তৈরি হচ্ছে। তাতে আপত্তি থাকার কথা ছিল না। কিন্তু এ ভাবে যদি একাধিক ডেটা কোড থাকে, তা হলে কোনটা কাজে লাগবে? দু’টো দেওয়ার তো কোনও সুযোগ নেই। আর একটা দিলে পরবর্তীকালে যখন পরীক্ষা হবে, তখন আর একটি দিয়ে যদি করা হয়? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।
১৯৫১ সালের রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জির অবশিষ্টাংশ ছাড়া আর যে সব সরাকরি দলিলকে উত্তরাধিকারের বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তা হল ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যের ভোটার তালিকা। অথচ এ ভোটার তালিকার অস্তিত্বও সব জায়গায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এক সময়ে অসমের অধিবাসীদের ডিএনএ পরীক্ষার কথাও বলেছিলেন। অবশ্য পরবর্তী কালে আরও কতগুলো নথি বা দলিলকে উত্তরাধিকারের সমার্থক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় সে সমস্যা অনেকটাই লাঘব হয়েছে। ভিন রাজ্য থেকে আসা লোক জন বিশেষ করে আদিবাসী এবং চা-জনগোষ্ঠীদের সমস্যা লাঘব করতে সুপ্রিম কোর্টের অতি সাম্প্রতিক আদেশও কাযর্কর হবে। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান আদেশে অসমে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীর লোকদের রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জিতে নামভুক্তির ব্যাপার সহজতর হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আবার ‘মূল অধিবাসী’ নামে আর এক শ্রেণির নাগরিকদের কথা উল্লেখ করে আর একটি বিতর্ক উসকে দিয়েছে। অসম থেকে প্রকাশিত বাংলা ও অসমিয়া সংবাদপত্রগুলিতে ‘মূল অধিবাসী’র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘খিলঞ্জিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অসমিয়া ভাষায় ‘খিলঞ্জিয়া’ শব্দটি একটি বিশেষণ। এর অর্থ পুরুষানুক্রমে নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাসকারী জনগণ বা পুরুষানুক্রমে ভোগদখল করা নির্দিষ্ট জমিজিরেতের অধিকারীদের বোঝাতে এই বিশেষণ ব্যবহার করা হয়।
এই খিলঞ্জিয়া কারা? এ নিয়ে বিরাট বিতর্ক আছে। সমাধান এখনও হয়নি। কিছু দিন আগে অসম বিধানসভায় অধ্যক্ষ বিধানসভায় পূর্ববিজ্ঞপ্তি ছাড়াই সম্পূর্ণ আকস্মিক ভাবেই খিলঞ্জিয়ার একটি নিজস্ব সংজ্ঞা উল্লেখ করলে সভায় হইচই বেধে যায়। এবং তাঁর এ প্রস্তাবটি ফেরত দেওয়া হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অসম প্রদেশটিকে টিকে থাকার যোগ্যতাসম্পন্ন করে তোলার জন্য যখন অন্য অঞ্চলের সঙ্গে বর্তমান বরাক উপত্যকা অঞ্চলকে জুড়ে দেওয়া হয় তখন এ অঞ্চলের লোকেরা তাদের ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে জমিজিরেত এমনকী ভূবাসন ব্যবস্থা নিয়েই অসমের প্রবহমান ইতিহাস প্রক্রিয়ায় শরিক হয়েছিলেন। অপর দিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রাক অহোম যুগের অদিবাসীরাও রয়েছে। এ অবস্থায় খিলঞ্জিয়া জনগোষ্ঠী বা মূল আদিবাসী কারা তা আরও বিশদ না হওয়ায় বিতর্কের অবকাশ রয়েই গেল।
লিগ্যাসি ডেটার গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ মনোভাব শিথিল হওয়ায় অসমের সকল শ্রেণির লোকদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটির সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে হয়। কিন্তু তার পরও যদি দেখা যায় কয়েক লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে গেছেন, তখন কী হবে? এটা খুবই ভাবার বিষয়। তরুণ গগৈ ২০১৪ সালের ভোটার তালিকাকে লিগ্যাসি ডেটার অন্যতম দলিল হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়ে কৌশলে বাজিমাত করতে চেয়েছেন। কিন্তু এর ফলে যে সামাজিক উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে তা সামাল দেওয়া খুব সহজ হবে না। দেশভাগের সময় পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা ভারতে চলে এলে তাদের পুনর্বাসন দান ছিল আমাদের জাতীয় প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে ২০০৪ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এ ভাবে বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের জন্য আইন প্রণয়ন এখনই প্রয়োজন। তার পরও যদি কিছু অনুপ্রবেশকারীর সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে তাদের প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ সহজতর হবে। নতুবা রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জির ঘনঘটা যে অশনি সংঙ্কেত দিচ্ছে তা তুমুল ঝড়ের সৃষ্টি করে আমাদের সমস্ত স্থিতিশীলতাকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে এক ঘূর্ণাবর্তে ফেলে দিতে পারে এই রাজ্যকে।
(লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও ইতিহাসবিদ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy