খাবারের এই ছবিই পোস্ট করেছেন বিএসএফ জওয়ান। ছবি: সংগৃহীত।
চার দিকে যে রকম বরফ, পাহাড়ের রংটা যে রকম, সে সব দেখে মনে হচ্ছে জায়গাটা প্রায় ৮০০০ ফুট উঁচুতে। এই রকম একটা দুর্গম এলাকায় ২৪ ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণরেখা আগলে দাঁড়িয়ে থাকা খুব সহজ কাজ নয়। শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ে, মনও। শরীর আর মনটাকে তরতাজা রাখতে লাঞ্চ আর ডিনারের প্লেটটা ভরপুর আর স্বাস্থ্যকর হওয়া খুব জরুরি। যে কোনও সশস্ত্র বাহিনীই এই বিষয়টাতে খুব গুরুত্ব দেয়। কিন্তু, তেজবাহাদুর যাদব ওই বরফঢাকা পাহাড়টাতে দাঁড়িয়ে লঙ্গরে তৈরি চাপাটি-ডালের যে ছবি তুলেছেন, তা দেখে একটু আশ্চর্য হতেই হচ্ছে।
আশ্চর্য হচ্ছি দুটো কারণে। দুটো প্রশ্ন উঠছে। প্রথম প্রশ্ন, জওয়ানদের খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হবে কেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, যে ভাবে অভিযোগটা তোলা হয়েছে এবং যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার যৌক্তিকতা এবং সত্যতা কতটা?
জবাব পরে খোঁজা যাবে। তার আগে ছবিটা একটু স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া দরকার। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলির সিংহ ভাগেই নজরদারি চালানোর কাজটা বিএসএফ করে। পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাত তো বটেই, জম্মু-কাশ্মীরে ভারত-পাক নিয়ন্ত্রণ রেখাতেও পাহারাদার বিএসএফ-ই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব, রাজস্থান বা গুজরাতের সীমান্তের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণরেখার কিছু ফারাক রয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখা সরাসরি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সেখানে বিএসএফ সেনার অধীনে কাজ করে। অন্যান্য সীমান্তে রেশনিং ভাতা বাবদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যে টাকা পাঠায়, সেই টাকায় জওয়ান থেকে অফিসার পর্যন্ত সকলের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়। নিয়ন্ত্রণরেখায় রেশনিং ভাতা বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কাছে আসে না। সেনাবাহিনীর খরচে খাওয়া-দাওয়া চলে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রেশনিং ভাতার টাকাটা প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে দিয়ে দেয়।
খাওয়ার খরচ যে-ই জোগাক, লাঞ্চ প্লেট বা ডিনার প্লেটে কী কী থাকবে, তা কিন্তু জওয়ানরা নিজেরাই স্থির করেন। সব ক্যাম্পেই একটা করে মেস কমিটি থাকে। মূলত নীচের তলার কর্মীদের নিয়েই সেই কমিটি তৈরি হয়। কমিটিই রোজ ঠিক করে, মেনুতে কী থাকছে। এক জন সিনিয়র অফিসার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে থাকেন। কম্যান্ডার থেকে হাবিলদার, জওয়ান থেকে কুক— সবার জন্য কিন্তু একই মেনু। আলাদা ব্যবস্থা কারও জন্যই থাকে না। জওয়ান যদি তাঁর প্লেটে চাপাটি, ডাল আর মাংস পান, তা হলে কম্যান্ডিং অফিসারও সেই প্লেটই পাবেন। অফিসার বড়জোর এই সুবিধাটুকু পেতে পারেন যে তিনি যখন খেতে বসলেন, তাঁর চাপাটিগুলো কুক তখনই বানিয়ে দিলেন। এ ছাড়া আর কোনও ফারাক নেই।
তেজবাহাদুর যাদব। এই জওয়ানের পোস্ট করা ভিডিও ঘিরেই আজ চাঞ্চল্য গোটা দেশে। এই ছবি নিয়ন্ত্রণরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে কর্তব্যরত অবস্থাতেই তোলা। ছবি: সংগৃহীত।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮১— এই দু’বছর আমি নিজেও নিয়ন্ত্রণরেখায় ছিলাম। কুপওয়ারা সেক্টরের দুর্গম পাহাড়। তখন আমি সেক্টর কম্যান্ডার। সামরিক দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি কিন্তু আমাকে আমার বাহিনীর খাওয়া-দাওয়া, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার খেয়ালটাও রাখতে হত। সশস্ত্র বাহিনীর কর্মীদের খাওয়া-দাওয়ার মানটা কেমন হবে, তা কিন্তু খুব স্পষ্ট করেই বলে দেওয়া রয়েছে। বাহিনীতে যখন কেউ নতুন ঢুকলেন, তখন তাঁকে যে ধরনের পরিশ্রমসাধ্য ট্রেনিং-এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাতে রোজ তাঁর ৩৮০০ থেকে ৪০০০ ক্যালোরি প্রয়োজন। আবার হেড কোয়ার্টারে যিনি চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ সামলাচ্ছেন, তাঁর অনেক কম ক্যালোরি প্রয়োজন। এই কথাগুলো মাথায় রেখেই ডায়েট চার্টটা তৈরি হয়। খাবারের প্লেটটা যাতে একঘেয়ে না হয়ে যায়, তার জন্য মেস কমিটি রোজ মেনু বদলে দেওয়ার চেষ্টাও করে। কিন্তু দুর্গম অঞ্চলে যখন কোনও ব্যাটালিয়ন কাজ করছে, তখন রোজ মেনু বদলে দেওয়ার সুযোগটা একটু কম থাকে। কারণ সেখানে মূলত টিনড্ ফুডের উপর নির্ভর করতে হয়। হিমায়িত মাংস, হিমায়িত ডিম, প্রচুর কাজু, শুকনো ফল— এই সবই মূলত থাকে। ক্যালোরির খেয়াল রাখতে গিয়ে রোজ এই একই খাবার একঘেয়ে হয়ে ওঠে কখনও কখনও। খিদে থাকলেও কোনও কোনও দিন আর খেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাহিনীতে স্বাস্থ্যকর খাবার দেওয়া হয় না। তাই ২৯ ব্যাটালিয়নের জওয়ান ফেসবুকে ভিডিও ছেড়ে যে অভিযোগটা তুলছেন, সেটা মেনে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
যাই হোক, বিএসএফ জওয়ান খাওয়া-দাওয়ার মান নিয়ে যে অভিযোগ তুলেছেন, তা কিন্তু বেশ গুরুতর অভিযোগ। তাই এই অভিযোগের তদন্ত অবশ্যই হওয়া উচিত। যদি সত্যিই দেখা যায় যে ওই রকম দুর্গম এলাকায় কর্তব্যরত জওয়ানদের ঠিক মতো খেতে দেওয়া হচ্ছে না, তা হলে কম্যান্ডিং অফিসারকে শাস্তি পেতে হবে। কারণ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের সময় মতো খাওয়া, সময় মতো ছুটি, সময় মতো ঘুম এবং সময় মতো বেতন নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাঁর। তাই তেজবাহাদুর যাদবের তোলা অভিযোগে যদি বিন্দুমাত্র সত্যতা পাওয়া যায়, তা হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। বাহিনীর মনোবলের স্বার্থেই তা জরুরি।
আর তদন্তে যদি দেখা যায়, তেজবাহাদুর যাদব যে অভিযোগ তুলেছেন, তা ভিত্তিহীন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
ভিডিওটা দেখে আমার কিন্তু মনে হয়েছে, বেশ কিছু দিন রিহার্সাল দেওয়ার পর এই ভিডিওটি রেকর্ড করা হয়েছে। না হলে এক জন জওয়ান ক্যামেরার সামনে এত ঝরঝরে ভাষায় কথা বলছেন, অভিযোগগুলো এত গুছিয়ে তুলে ধরছেন এবং জানাচ্ছেন যে আরও দু’টি ভিডিও রয়েছে, যা ক্রমশ প্রকাশ্য— এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
আরও পড়ুন: পেটে কিল মেরে সীমান্ত সামলাই, বিস্ফোরক ভিডিও বিএসএফ জওয়ানের
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যদি কোনও জওয়ানের অভিযোগ থাকে, তা হলে প্রথমে কম্যান্ডারের কাছে তিনি অভিযোগ জানাবেন। কাজ না হলে, আরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি অভিযোগ জানাতে পারেন। তাতেও কাজ না হলে, খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেই অভিযোগ জানানো যেতে পারে। কিন্তু এই জওয়ান সেই প্রক্রিয়া আদৌ অনুসরণ করেছেন কি? সংশয় রয়েছে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ না জানিয়ে যে ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগের ঝাঁপি উজাড় করেছেন তিনি, তা কিন্তু চূড়ান্ত শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ইচ্ছা হলেই মিডিয়ার সামনে মুখ খুলতে পারেন না। নির্দিষ্ট কয়েক জন অফিসার মিডিয়ায় মুখ খুলতে পারেন। তেজবাহাদুর যাদব, সেই নিয়ম ভেঙেছেন। ফলে তাঁর ভূমিকা ভাল ভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।
আবার শুনছি, এই জওয়ান নাকি কাউন্সেলিং-এ ছিলেন। শারীরিক, মানসিক বা পারিবারিক সমস্যার কারণে বাহিনীর কোনও সদস্য যদি স্থিতিশীলতা হারান, তা হলেই এই কাউন্সেলিং হয়। এই জওয়ানের ক্ষেত্রে সমস্যা ঠিক কী ধরনের, জানি না। কিন্তু তাঁর স্থিতিশীলতা বা ভারসাম্য নিয়ে যখন প্রশ্ন ছিল, তখন নিয়ন্ত্রণরেখার মতো সংবেদনশীল অঞ্চলে তাঁকে কী ভাবে নজরদারিতে মোতায়েন করা হল, কোন বুদ্ধিতে তাঁর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হল, কম্যান্ডিং অফিসারকেও সেই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy