(ফাইল চিত্র)
কয়েকটা দিন আগেই বাজাচ্ছিলেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...
লন্ডনের অনুষ্ঠান। নিজের সবচেয়ে প্রিয় যন্ত্রটিই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন আমজাদ আলি খান। যেমনটি করে আসছেন গত ৪৫ বছর ধরে। কিন্তু ফেরার পথে বিমানে খোওয়া গিয়েছে সেই সাধের সরোদ। এত দিনের যন্ত্রটির সঙ্গে এই ভাবে বিচ্ছেদ ঘটবে, ভাবতে পারেননি শিল্পী। মন ভেঙে গিয়েছে তাঁর।
আজ সকালে আমজাদ নিজেই টুইট করে খবরটা প্রথমে জানান। ৬৮ বছরের আমজাদ লেখেন, “১৯৯৭ সালে আমার সরোদটা নষ্ট করার পরে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এখন সেটি হারিয়েই ফেলেছে। ৪৮ ঘণ্টা হয়ে গেল, আমি উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছি। ওটা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি!!!”
আমজাদের সরোদ মানেই কলকাতার হেমেন্দ্রচন্দ্র সেনের হাতে তৈরি। হেমেন্দ্রবাবুর বানিয়ে দেওয়া সরোদ ছাড়া কোনও দিন বাজাননি শিল্পী। তাঁর দুই ছেলে, আমন ও আয়ানও তা-ই। হেমেন্দ্রবাবু এখন আর বেঁচে নেই। আমজাদ দুঃখ করে বলছিলেন, ১৯৯৭ সালেও এই সরোদটাই বিমানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে বার হেমেন্দ্রবাবু বড় যত্ন করে সেটি সারিয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্মৃতির স্পর্শ সঙ্গে নিয়েই হারিয়ে গেল যন্ত্রটি।
২১ জুন ডার্টিংটন কলেজের একটি অনুষ্ঠানের জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন আমজাদ। অনুষ্ঠানটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপরে বরাবরই ঝোঁক আমজাদের। সুচিত্রা মিত্রর সঙ্গে একটি অ্যালবামও করেছিলেন তিনি। এ বারের অনুষ্ঠানেও রবীন্দ্রনাথের সুর বাজানোর জন্য সবচেয়ে পছন্দের সরোদটিই নিয়ে গিয়েছিলেন। আনন্দবাজারকে ফোনে বলছিলেন, এই যন্ত্র এর আগেও তাঁর সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরেছে। লন্ডনেই কার্নেগি হল-এর বিখ্যাত অনুষ্ঠানে এই যন্ত্রটিই বেজেছিল। আমেরিকার শ্রোতাদের মাতিয়েছিল এই সরোদ। কলকাতার সারা রাত্রিব্যাপী একক অনুষ্ঠানেও আমজাদের হাতে জাদুর মূর্ছনা ছড়িয়েছিল সে। জীবনের বহু ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই যন্ত্র।
২৮ জুন লন্ডন থেকে ফেরার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে পা রেখে লাগেজ সংগ্রহ করতে গিয়েই আমজাদ আবিষ্কার করেন, সাধের সরোদটি পাওয়া যাচ্ছে না। ঠায় চার-পাঁচ ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করেও কোনও সুরাহা হয়নি। আমজাদ জানিয়েছেন বিমানসংস্থার তরফে তাঁকে জানানো হয়েছিল, পরের উড়ানে আসতে পারে সরোদটি। কিন্তু কোথায় কী? এখনও পর্যন্ত সেই সরোদ তাঁর হাতে পৌঁছয়নি।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ কী বলছে? “ওরা সংবাদমাধ্যমে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা হয়ে গেল, আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। এত বড় বিমানসংস্থা কী করে এত দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়?” বিরক্তি ঝরে পড়ে শিল্পীর গলায়। তিনি জানিয়েছেন, হিথরো বিমানবন্দরের পাঁচ নম্বর টার্মিনাল থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিএ-১৪৩ উড়ানে উঠেছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী শুভলক্ষ্মী। ওঠার সময়ই তাঁরা লক্ষ করেছিলেন কিছু ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র ওই একই বিমানে তোলা হচ্ছে। “আমার স্ত্রী তখনই আমায় সতর্ক করে বলেছিলেন, এরা নিশ্চয় কোনও গোলমাল পাকাবে। আর সেটাই হল,” বললেন আমজাদ।
বিমানসংস্থা সূত্রেও মেনে নেওয়া হয়েছে, সে দিন হিথরোর পাঁচ নম্বর টার্মিনালের লাগেজ বিভাগে সমস্যা ছিল। একটি বিবৃতিতে তারা বলেছে, “এই সমস্যা গত বৃহস্পতিবার থেকেই চলছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, যাতে প্রতিটি যাত্রী তাঁদের হারানো লাগেজ খুঁজে পান। কিন্তু সময়টা একটু বেশিই লাগছে। যাত্রীদের অসুবিধার জন্য আমরা তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
আমজাদ সব সময়ই বলে থাকেন, তাঁর সরোদ তাঁর প্রাণ। যখনই বিমানে কোথাও সফর করেন, সেই বিমানসংস্থাকে মনে করিয়ে দেন, যেন তাঁর যন্ত্রটি একটু সাবধানে দেখভাল করা হয়। কিন্তু তা-ও বারবার তাঁর সঙ্গেই কেন এই অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো ঘটে, সেটাই এ দিন আক্ষেপ করছিলেন শিল্পী। এর আগে ১৯৯৭ সালেই শুধু নয়, বিপত্তি ঘটেছিল ২০১০-এও। সে বার জানুয়ারিতে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে আমদাবাদ থেকে মুম্বই যাওয়ার সময় ভেঙে যায় আমজাদ আলির সরোদ। সেই সময়ও সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে হইচই হয়েছিল। আমজাদ নিজে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “সরোদ নয়, আমার হৃদয়টাই ভেঙে গিয়েছে।”
সব মিলিয়ে এখন ২৫টি সরোদ আছে আমজাদ আলির পরিবারে। কিন্তু যেটি হারিয়েছে, সেটি ছিল আমজাদের প্রাণ! বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটি বিশেষ যন্ত্রের প্রতি শিল্পীদের একটা আলাদা টান থাকে। সেই যন্ত্রটি কখনও কাছছাড়া করতে চান না তাঁরা। বাছা বাছা অনুষ্ঠানে প্রিয় যন্ত্রটি ছাড়া যেতেই চান না। আর সে যন্ত্রও যেন শিল্পীর হাতে পড়লেই কথা বলতে শুরু করে! আলাউদ্দিন খান সাহেবের প্রিয় সরোদ এখনও মাইহারে রাখা আছে। আলি আকবর খানের একটি সরোদ ছিল, যেটি তিনি ১৮-১৯ বছর বয়স থেকে শুরু করে আমৃত্যু বাজিয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় শিল্পীর বাড়িতে রয়ে গিয়েছে সেটি। যন্ত্র আর যন্ত্রীর এই আশ্চর্য সম্পর্কের গল্প করতে গিয়ে প্রয়াত রাধিকামোহন মৈত্রের কনিষ্ঠতম শিষ্য সোমজিৎ দাশগুপ্ত বলছিলেন, রাধুবাবুর দু’টি সরোদ ছিল। কিন্তু তার একটিই তিনি বাজাতেন। ১৯৩৫ সালের তৈরি সে সরোদই এখন সোমজিৎবাবু বাজান।
হারানো সরোদের সঙ্গে আমজাদের সম্পর্কও এমনই। সুরের সেই বাঁধন এই ভাবে আচমকা ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। প্রধানমন্ত্রী আর বিমান মন্ত্রকের কাছে শিল্পী অনুরোধ জানিয়েছেন, সরোদটি যদি খুঁজে দেওয়া যায়। বিমানসংস্থার কাছেও তাঁর একটাই দাবি, “কোনও ক্ষতিপূরণ নয়, আমার ৪৫ বছরের সঙ্গীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy