মহাত্মা গান্ধীর ডান্ডি যাত্রা। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
মৃত্যুর ৭৫ বছর পরেও গান্ধী-পথেই চলছে ভারতীয় রাজনীতির যাত্রা। ব্যতিক্রম নয় বাংলাও। স্বাধীন ভারতের গোড়া থেকে এ পর্যন্ত রাজনীতির ধারা, ধারাবহিকতা, ধারণা সব কিছুতেই বদল এসেছে আমূল। কিন্তু রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে থেকে গিয়েছে, ছড়িয়েও গিয়েছে পথ থেকে পথে পদযাত্রার গান্ধী-পথ। বাংলার রাজনীতি আবার তা দেখবে আগামী লোকসভা ভোটের আগে। রঙ নির্বিশেষে সব দল, সব শিবির পুজোর মরসুমের পর থেকেই নেমে পড়ছে নানা আঙ্গিকের পদযাত্রায়। তৃণমূল থেকে বাম, কংগ্রেস থেকে হিন্দুত্ববাদী— সবাই নিয়ে ফেলেছে কর্মসূচি।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে প্রায় দু’মাস ধরে ‘নবজোয়ার যাত্রা’ করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকে বলেন, রোদে তেতে, ঘামে ভিজে অভিষেকের ৫৫ দিনের কর্মসূচি দলের ভিতর, সমগ্র রাজনীতিতে তাঁর ‘নবনির্মাণ’ হয়েছে। আবারও পথে নামার পরিকল্পনা রয়েছে অভিষেকের। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, উৎসব মিটলে নবজোয়ারের ধাঁচেই ৪২টি লোকসভা স্পর্শ করে যাবে দলের কর্মসূচি।‘
বিজেপি এখনও তেমন কোনও কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেনি। তবে সঙ্ঘ পরিবারের আর এক সদস্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ১ অক্টোবর রাজ্যের একাধিক জায়গা থেকে ‘শৌর্য যাত্রা’ শুরু করবে। তা রাজনৈতিক কর্মসূচি না হলেও, অনেকের মতে, লোকসভার আগে হিন্দুত্ববাদী হাওয়াই তোলার সেই যাত্রা। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়েই পাঁচটি রথযাত্রা বের করেছিল বিজেপি। সূচনায় কোচবিহারে ছিলেন সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা। সমাপ্তিতে কাকদ্বীপে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই তাদের প্রতিষ্ঠা দিবস ৩ নভেম্বর কোচবিহার থেকে পদযাত্রা শুরু করবে। সব জেলা ছুঁয়ে সেই কর্মসূচি শেষ হবে ৭ জানুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশের মধ্যে দিয়ে। ভোটের আগে তরুণ প্রজন্মকেই রাস্তায় নামাতে চাইছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। হাঁটাতেও চাইছে। প্রদেশ কংগ্রেসও পরিকল্পনা করেছে, লোকসভার আগে ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্র ছুঁয়ে যাবে তাদের যাত্রা। পায়ে হাঁটা মিছিলেই গুরুত্ব দিচ্ছে বিধান ভবন। সংসদের অধিবেশন মিটলে কলকাতায় ফিরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করে ফেলবেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা সাড়া ফেলেছিল। স্বয়ং রাহুলই বলেছেন, সেই যাত্রা তাঁকে ‘নতুন এক মানুষ’ তৈরি করে দিয়েছে। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছেন রাহুল। রাজস্থানে যখন রাহুলের যাত্রা প্রবেশ করেছিল, তখন মরুরাজ্যের একাংশের কংগ্রেস নেতা মহাত্মার যাত্রার সঙ্গে ‘ভারত জোড়ো’র তুলনা টেনেছিলেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন রাহুল। কিন্তু সেই তুলনা প্রমাণ করে দিয়েছিল, মহাত্মার ‘যাত্রা’ এখনও প্রাসঙ্গিক। রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা বাংলায় আসেনি। তবে সেই সময়ে রাজ্যে কাকদ্বীপ থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত যাত্রা করেছিলেন কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি অধীর। সামনেই আরও একটি যাত্রার পরিকল্পনা রয়েছে রাহুল তথা কংগ্রেসের। লোকসভা ভোটকে সামনে রেখেই। যা হয়তো উৎসবের মরসুম মিটলেই গুজরাত থেকে শুরু হয়ে যাবে অরুণাচল পর্যন্ত। ছুঁয়ে যাবে বাংলাকেও।
রাজনীতির বহিরাঙ্গে অনেক বদল হয়েছে। বদলেছে প্রচারের ধারা। আমূল বদলে গিয়েছে উপকরণ। ইন্টারনেটের দ্রুত পরিবর্তনশীল যুগে রাজনৈতিক প্রচার এখন যতটা না রাস্তায়, তার চেয়ে বেশি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। ছোট-বড় সব দল নেটে ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু সমান্তরাল ভাবে সব দলই চাইছে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে, কিংবা যাত্রা করতে। প্রায় এক শতাব্দী আগে যে পথ দেখিয়েছিলেন মোহনদাস করমচন্দ গান্ধী।
ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের পর ১৯৩০ সালে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী সবচেয়ে শক্তিশালী আন্দোলন। ৯৭ বছর আগের সেই আন্দোলনের আভিঘাত টের পেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকেরাও। আমদাবাদের সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি যাত্রা শুরু করেছিলেন গান্ধী। ২৪ দিনে ৩৯০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছেছিলেন গুজরাত উপকূলের ডান্ডি গ্রামে। ব্রিটিশের চাপানো লবণের উপরে করের ফতোয়া উড়িয়ে সমুদ্রের জল থেকে নুন তৈরি করেছিলেন। গান্ধীর সঙ্গে সেই যাত্রায় বিরাট সংখ্যক মানুষ ছিলেন না। জনা ৮০ সমর্থক নিয়েই হেঁটেছিলেন। কিন্তু যে যে জনপদ ছুঁয়ে সবরমতী থেকে ডান্ডি পৌঁছেছিলেন গান্ধী, সেই সেই জায়গা আন্দোলিত হয়েছিল।
তার পর সময় এগিয়েছে। স্বাধীনতার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছে দেশ। স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু যাত্রার রাজনীতি, রাস্তা ধরে নিজেদের কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলার ধারা অমলীন। ডান্ডি অভিযানে ভারতীয় রাজনীতিতে যে পদচিহ্ন গান্ধীজি রেখে গিয়েছিলেন, দশকের পর দশক ধরে তারই অনুসরণ হয়ে চলেছে। দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থার শেষে ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী প্রবল ভাবে পরাস্ত হয়েছিলেন। এর পরে কংগ্রেসের মরা গাঙে বান আনতে রাজ্যে রাজ্যে যাত্রা করেছিল কংগ্রেস। ইন্দিরাও বেরিয়েছিলেন। কংগ্রেসের গায়ে তখন জরুরি অবস্থার ‘কালি’। সে সব পেরিয়ে ১৯৮০ সালে ফের ইন্দিরার মসনদে ফিরে আসা ভারতীয় রাজনীতিতে মাইফলক হয়ে রয়েছে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা হত্যার পরে রাজনীতিতে ‘আনকোরা’ রাজীবকে প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে বসায় কংগ্রেস। বিমানচালক রাজীব রাস্তায় নেমে গ্রামীণ ভারতের কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। ইন্দিরা-পুত্রের সেই কর্মসূচির নাম ছিল ‘ভারতযাত্রা’। মাইলের পর মাইল হাঁটা, অনাড়ম্বর সফর, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সঙ্গে পাত পেড়ে খাওয়া সবই করেছিলেন তিনি সেই যাত্রায়। অনেকেই দাবি করেন, রাজনীতিক রাজীবের নির্মাণ করে দিয়েছিল সেই পথ।
আটের দশকে রাজীবের সেই যাত্রার পর অন্য এক যাত্রা তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল দেশের রাজনীতিতে। অনেকে বলেন, সেই যাত্রাটি দেশের রাজনীতির অভিমুখই ঘুরিয়ে দেয়। বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর নেতৃত্বে ‘রামরথ যাত্রা’। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের রাজনৈতিক সূচনা ছিল সেটাই। ১৯৯০-এর সেপ্টেম্বরে সোমনাথ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন আডবাণী। যে পথ দিয়ে রথ গড়িয়েছিল, সে সব জায়গায় হিংসা, বিহারে যাত্রা প্রবেশের পর আডবাণীদের গ্রেফতার, উত্তরপ্রদেশে প্রায় দেড় হাজার গেরুয়া সমর্থকের গ্রেফতারি রাজনীতির পরিচিত ছককে ভেঙে দিয়েছিল। তার পরেও আডবাণী রথ নিয়ে বেরিয়েছেন, তাঁর সতীর্থ মুরলীমনোহর জোশীও দেশ ঘুরেছেন, কিন্তু লালকৃষ্ণের প্রথম যাত্রাই লাল কালিতে লেখা ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে। কারণ, সেটি নিঃসন্দেহে ছিল দেশের রাজনীতির মোড় ঘোরানো রাজনৈতিক কর্মসূচি।
বাংলায় বাম রাজনীতির প্রিয় গানই তো— ‘পথে এ বার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা।’ বামেরা সাক্ষরতা আন্দোলনের সময়ে রাজ্যে অনেক যাত্রা করেছিল। মূলত তা ছিল পদযাত্রা। মাইলের পর মাইল হাঁটা। এ ব্যাপারে বাম নেতাদের মধ্যে বিমান বসুকে তুলনাহীন বলা হয়। অনেকে বলেন, রাজ্যে এমন কোনও জনপদ নেই, যেখানে বিমান হাঁটেননি। হলদিয়ায় শিল্পাঞ্চল গঠন ও বক্রেশ্বরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গঠনের আন্দোলনের সময়েও বাম ছাত্র-যুবদের পদযাত্রা দেখেছিল রাজ্য রাজনীতি। তবে বামপন্থীদের মধ্যেই এমন সমালোচনা শোনা যায় যে, বাম সরকারের বয়স যত বেড়েছে, বাংলার সিপিএমে ‘জমিদারি মানসিকতা’ যত জাঁকিয়ে বসেছে, তত ক্রমশ হাঁটা থেকে দূরে সরতে শুরু করে তারা। বাম জমানায় যা নতুন করে শুরু করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সচিত্র ভোটার কার্ডের দাবিতে মমতার নেতৃত্বাধীন যুব কংগ্রেসের আন্দোলন শুরুই হয়েছিল জঙ্গলমহল থেকে। যার সমাপ্তি কর্মসূচি ছিল মহাকরণ অভিযান। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের সেই কর্মসূচিতেই পুলিশের গুলিতে ২১ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যু হয়। যে দিনটিকে ‘শহিদ দিবস’ হিসাবে এখনও পালন করে তৃণমূল। মমতা জমানায় আবার বামেরা বাংলায় বেশ কিছু পদযাত্রা করেছিল। যার অন্যতম ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সিঙ্গুর থেকে শালবনি পর্যন্ত পদযাত্রা। যার সূচনা কর্মসূচি থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরাসরি সে বারের ভোটের জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করার বার্তা দিয়েছিলেন।
রাজ্যে রাজ্যে অনেক আঞ্চলিক দলও এই পথেই হেঁটেছে, হেঁটে চলেছে। বিহারে আরজেডি, তেলঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতি, পঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দল, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে—নানা নামে যাত্রা করেছে। প্রশান্ত কিশোরের মতো ভোটকুশলীরাও রাজনৈতিক দলগুলিকে জনসম্পর্কের কৌশল হিসাবে যাত্রা আয়োজনের পরামর্শ দেন। তাঁদেরও স্লোগান— ‘গান্ধীং শরণং গচ্ছামি’। লোকসভা ভোটের আগে বাংলাতেও সেই গান্ধীর পথেই হাঁটতে চাইছে ডান, বাম নির্বিশেষে সব দল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy