দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
চাহিদায় সমস্যা। অতিমারির এই সময়ে দীর্ঘ কয়েক মাস কলকারখানা বন্ধ থাকায় লোকের চাকরি গিয়েছে। আয় বাড়ন্ত। তাই অর্থনীতিবিদরা সরকারকে বলছেন খরচ বাড়াতে। যাতে উৎপাদন চাগিয়ে তুলতে বাজারে চাহিদা বাড়ে। এটা নীতির সমস্যা। কিন্তু তার থেকেও বড় সমস্যা আসছে আমাদের থেকেই। আর তা হল বার্ধক্যে আয়ের সমস্যা। এটা কিন্তু তৈরি হচ্ছে আমাদের খরচের প্রবণতা থেকেই। অতিমারিতে যেমন খরচের রেস্ত ছিল না পকেটে, কিন্তু অন্য সময়ে যখন থাকে তখনও অবসরের পরে কী হবে তা না ভেবেই আমরা খরচ করে চলেছি।
রাষ্ট্রপুঞ্জের জনসংখ্যা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যেই ভারত জনসংখ্যায় চিনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বরের তকমা পাবে। যাঁরা ভারত কিসে চিনকে ছাড়াল তা নিয়ে হিসাবে ব্যগ্র, তাঁদের কাছে এটা শ্লাঘার তথ্য কিনা বলতে পারব না। কিন্তু আর্থিক দিক থেকে ভারতের ক্ষেত্রে তা যে আদৌ সুখবর নয় তা বলতে কোনও দ্বিধার জায়গা থাকছে না।
সমস্যাটা অবশ্য জনসংখ্যার নয়। এই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও যে বাড়ছে, চিন্তা তা নিয়েই। কারণ, যাঁরা বুড়ো হচ্ছেন তাঁদের হাতে কিন্তু এই বার্ধক্য যাপনের জন্য যথেষ্ট রেস্ত থাকবে না বলেই মনে করছে বিভিন্ন সমীক্ষা। এই জনসংখ্যার অঙ্কই বলছে, দেশে ৬০ বা তার বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তিন গুণ গতিতে। ২০৫০ সালের মধ্যেই বয়স্ক মানুষের (৬০ বা তার বেশি বয়সীর) সংখ্যা ছাড়াবে ৩২ কোটি আর ৮০ বা তার উপরের বয়সের মানুষের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৪ কোটি ৮০ লক্ষের ঘরে।
দেশে ৬০ বা তার বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তিন গুণ গতিতে।
আর এই এত কোটি বৃদ্ধকে তাঁদের সন্তান না দেখলে কিন্তু অবসর বাস সুখের হবে না। প্রুডেনশিয়াল গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজারস বা পিজিআইএমের ভারতীয় মিউচুয়াল ফ্যান্ডের প্রধান অজিত মেনন একটি মজার কথা বলেছেন নিয়েলসনের সঙ্গে ‘অবসরের পরে আয়’ নিয়ে করা এক সমীক্ষায়। আপনি অবসর যাপনের জন্য আপনার বাড়ি কোনও আর্থিক সংস্থাকে বন্ধক দিয়ে মাসিক আয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। আপনার অবর্তমানে ওই বাড়ির মালিকানা বর্তাবে সেই সংস্থাটির উপর যার কাছে আপনি বন্ধক রেখেছিলেন বাড়িটি।
অজিত মেনন বলেছেন, ভারতীয়রা এই বন্ধক আসলে সন্তানদের কাছে দিয়ে বসে থাকে। ভাবটা, “বাবা-মাকে দেখ। আমাদের যা আছে তা তো সবই তোদের।” হ্যাঁ। সত্যিই তো। এটা তো আসলে সেই রিভার্স মর্ডগেজ বা উল্টো বন্ধকেরই অন্য আর এক রূপ! কিন্তু কী সেই তথ্য যা অজিত মেননকে বাধ্য করল এই মন্তব্য করতে! চোখ রাখা যাক নিয়েলসনের এই সমীক্ষায়।
সমীক্ষাটি বলছে, শহরের মানুষ ক্রমাগত দৈনন্দিন খরচ বাড়াচ্ছে আর কমাচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য করা সঞ্চয়। আয়ের ৫৯ শতাংশই যাচ্ছে আজকের খরচে, যার আবার ৩৯ শতাংশ যাচ্ছে নানান ইএমআই, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদিতে। সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের জন্য আয়ের থেকে সরিয়ে রাখা অংশ ক্রমাগত কমছে। ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে পরিবারের সঞ্চয়ের হার জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র ২৩.৬ শতাংশ থেকে কমে ১৭.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অবসরের পরে তো ভরসা সেই কর্মজীবনের সঞ্চয়ই। আর তা যদি কমতে থাকে তা হলে বার্ধক্যে বাঁচার রেস্ত আসবে কোথা থেকে? গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখনও একই প্রশ্ন উঠে আসে। আগে গ্রামের মানুষ বার্ধক্য নিয়ে ভাবতেন না। যৌথ পরিবারই সেই দায়িত্ব নিয়ে নিত। কিন্তু গ্রামেও যৌথ পরিবার ভাঙছে, আর শহুরে সমস্যা হানা দিচ্ছে গ্রামের ঘরেও।
কিন্তু এখন আমরা শহুরে মানুষদের হিসাবটা নিয়ে নিই। এই সমীক্ষা বলছে, চাকুরিজীবীরা ৫১ বছরে গিয়েই হঠাত্ যেই মনে করছেন, “এই রে! অবসরের সময় তো এসে গেল! খাব কী?” আর তখনই শুরু করছেন অবসরের জন্য সঞ্চয়।এই সমীক্ষা যাঁদের নিয়ে করা হয়েছে তাঁরা গড়ে ৫০ লক্ষ টাকা নিয়ে কর্মজীবন শেষ করছেন। গড় বাৎসরিক আয়ের হিসাবে তা তার মাত্র ৮.৮ গুণ।
৫০ শতাংশের উপর মানুষ দুশ্চিন্তা করছেন বুড়ো হলে কী ভাবে চিকিৎসা খরচ মেটাবেন তা নিয়ে।
চাপ আরও আছে। এই সঞ্চয়ের কোথাও কিন্তু সেই অঙ্ক কাজ করছে না, যেখানে দাঁড়িয়ে একজন সঞ্চয়কারী আগামী দিনের সেই হিসাব করছেন যেখানে মুল্যবৃদ্ধির সমস্যা আছে, আছে হঠাৎ প্রয়োজনের খরচের জন্য কিছুটা টাকা সরিয়ে রাখার হিসাব।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, যখন খরচের ব্যাপারে ‘আজকেই বাঁচি’ এই বোধ নিয়ে ভবিষ্যতের প্রয়োজনকে উড়িয়ে দিচ্ছি আমরা, তখন সেই আমরাই কিন্তু বলছি ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৫০ শতাংশের উপর মানুষ দুশ্চিন্তা করছেন বুড়ো হলে কী ভাবে চিকিৎসা খরচ মেটাবেন তা নিয়ে। বলছেন, সন্তানদের উপর ভরসা করে লাভ নেই। অথচ এঁরাই কিন্তু জীবনযাপন যে ভাবে করছেন তাতে মনে হতেই পারে যে সন্তানরাই বার্ধক্যের বিমা।
এই দুশ্চিন্তার মূলে কিন্তু আরও একটা বোধ কাজ করছে। সমীক্ষাটি বলছে, অংশগ্রহণকারীরা সন্তানদের ভবিষ্যত্ নিয়ে খুব একটা আশার আলো দেখছেন না। যদিও সন্তানদের শিক্ষায়ই তাঁদের খরচের একটা বড় অংশ যায়। বিশেষ করে যাঁরা ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা মাসিক আয়ের মধ্যে আছেন।
আরও একটা মজার তথ্য উঠে এসেছে এই সমীক্ষায়। যাঁদের একের বেশি আয়ের উৎস তাঁরা কিন্তু অবসর জীবন নিয়ে অনেক নিশ্চিন্তে আছেন। আর যাঁদের সূত্র একটাই তাঁরা কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন আয়ের আরও কিছু সূত্র তৈরি করায়।
আরও পড়ুন: চিনের মানচিত্রে লাদাখ! টুইটারের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় কেন্দ্র
এখানে একটা কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। চাকুরিজীবী কিন্তু ঘোর অনিশ্চয়তায় বাঁচছেন, দিশাহীন ভাবে। সঞ্চয় করলেও কী ভাবে তা করতে হবে তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণাও তাঁদের নেই। সঞ্চয়ের বাজার কিন্তু খুব সহজ নয়। আমাদের জানা সেই জীবন বিমা আর ব্যাঙ্কের আমানতের বাইরেও কিন্তু আরও অনেক পথ আছে। তার জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের। এতদিন সাধারণ মানুষ সঞ্চয় উপদেষ্টাদের এড়িয়েই চলতেন। অনেকেই জানতেন না যে সঞ্চয়ের জন্যও উপদেষ্টা পাওয়া যায়। ননদের ছেলে ব্যাঙ্কে চাকরি করলেও তিনি এ ব্যাপারে সব নাও জানতে পারেন।কিন্তু এখন অনেকেই খুঁজছেন ভাল উপদেষ্টা।
এই সমীক্ষায় আরও একটা চিন্তার কথা উঠে এসেছে। বেশিরভাগই জানেন, অবসরের পরে নির্ভর করতে হবে চাকুরিজীবনের সঞ্চয়ের উপরেই। কিন্তু এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হওয়ার থেকে নিকট ভবিষ্যতের প্রয়োজন নিয়েই বেশি কথা বলতে আগ্রহী তাঁরা! উটপাখির মতোই মুখ আজকের সুখে গুঁজে।
আরও পড়ুন: আগামী সপ্তাহে অম্বালায় আরও তিনটি রাফাল, এপ্রিলে হাসিমারায়
এই আলোচনাকে গুটিয়ে আনলে যা দাঁড়ায় তা কিন্তু খুব একটা স্বস্তির নয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ প্রবীণ নাগরিকের খাতায় নাম লেখাবেন। কিন্তু রান্নাঘরের আঁচ কী ভাবে জ্বলবে তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি। যদিও এ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই, তবুও দিশার খোঁজে একটা বড় অংশ উপদেষ্টার কাছে যাননি। তবে হ্যাঁ, খোঁজ শুরু করেছেন উপদেষ্টার। বড় দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে বোধ ও বাস্তবের মধ্যে। যৌথ পরিবার ভাঙছে। বোধে ছিল সন্তান দেখবে। বাস্তব বলছে উল্টো কথা। কিন্তু যখন এই বাস্তব সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে ততদিনে হয়ত বড় সঞ্চয়ের সময়টা পার হয়ে গিয়েছে।
তাই আগামীতে কী ভাবে টিকবেন তা নিয়ে ভাবার সময় বোধহয় শুরু হওয়া উচিত কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকেই। উপদেষ্টার পরামর্শ মেনেই। আর কয়েক বছরের মধ্যেই প্রবীণদের নিয়ে কিন্তু বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে সরকারকেও। অতিমারি হয়ত শেষ হবে। কিন্তু এই সমস্যা থাকবেই। কুড়ে খাবে সামাজিক ঘুণপোকা হয়ে আমাদের সবাইকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy