Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Manmohan Singh

‘গুরুদেব’ পড়াশোনায় কেমন, খোঁজ নিয়েছিলেন নিজেই

শুক্রবার মতিলাল নেহরু মার্গে প্রয়াত মনমোহন সিংহের বাড়িতে একের পর এক রাজনৈতিক নেতা, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। গুরশরণ কউরের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে ভেসে এসেছে পুরনো স্মৃতি।

মনমোহন সিংহ।

মনমোহন সিংহ। —ফাইল চিত্র।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:৩৬
Share: Save:

‘আপনি কোন ডিভিশনে বিএ পাশ করেছেন?’

গুরশরণ কউরের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে মনমোহন সিংহ তাঁর হবু স্ত্রী-কে প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন পড়াশোনা নিয়ে। ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’-তে গুরশরণ কউর বিএ পাশ করেছেন শুনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তবে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। তাই গুরশরণের কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে হবু স্ত্রী পড়াশোনায় কেমন ছিলেন, তার খোঁজখবর করে এসেছিলেন।শুধু স্ত্রী না, তিন কন্যার ক্ষেত্রেও মনমোহন সিংহ পড়াশোনাকেই সবথেকে গুরুত্ব দিতেন। তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, জীবনে যা করতে হবে, সবটাই নিজের নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে। বাবা প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী বলে ঢাক পিটিয়ে কোথাও কোনও বাড়তি সুবিধা আদায় করা চলবে না।

শুক্রবার মতিলাল নেহরু মার্গে প্রয়াত মনমোহন সিংহের বাড়িতে একের পর এক রাজনৈতিক নেতা, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। গুরশরণ কউরের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে ভেসে এসেছে পুরনো স্মৃতি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেত্রী সনিয়া গান্ধী তো বটেই, মনমোহনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে সকলেই স্মরণ করেছেন তাঁর নম্রতা, ভদ্রতা, সততা, মূল্যবোধ, শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া ও সাধারণ জীবনযাত্রার কথা।

মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিন বছর এসপিজি-তে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন আইপিএস অফিসার অসীম অরুণ। এখন তিনি উত্তরপ্রদেশের কনৌজ সদরের বিজেপি বিধায়ক। যোগী আদিত্যনাথের সরকারের মন্ত্রীও। অসীম অরুণ এ দিন তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট বড় গাড়িতে চড়তে হলেও মনমোহন সিংহ তাঁর সাদা রঙের মারুতি ৮০০ গাড়িটিকেই নিজের গাড়ি বলে মনে করতেন। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তাঁর কনভয়ের পিছনে সেই মারুতি গাড়ি দাঁড় করানো থাকত। তাঁর সময়জ্ঞান ছিল শেখার মতো। রাতে এক ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। আর তাঁর মেয়েদের দেখে কেউ জানতেই পারত না যে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে।’’

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এবং তার আগে-পরে মনমোহন সিংহ এই সাধারণ জীবনযাত্রাই বহাল রেখেছেন। মনমোহন যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন তাঁর দফতরের এক কর্মী প্রতি মাসের পয়লা তারিখে সংসদ ভবনে স্টেট ব্যাঙ্কের শাখায় হাজির হতেন। সঙ্গে থাকত মনমোহন সিংহের সই করা ‘সেল্ফ’ চেক। সেই চেক ভাঙিয়ে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা তুলে নিয়ে যেতেন ওই কর্মী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী গুরশরণ কউর শরীর সুস্থ থাকলে বরাবরই সাউথ অ্যাভিনিউয়ে মাদার ডেয়ারির শাকসবজির দোকানে এসে নিজে বাজার করে থাকেন।

১৯৯১ সালে মনমোহন সিংহের আর্থিক উদারীকরণের হত ধরেই দেশের মধ্যবিত্ত বাজার অর্থনীতির ডানায় ভর করে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল। লাইসেন্স রাজ শেষ করা, টাকার অবমূল্যায়নের মতো একগুচ্ছ সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত আইএফএস রামু দামোদরণ সে সময় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কাজ করতেন। টাকার অবমূল্যায়নের পরে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর হাতে একটি মোটা টাকার চেক দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করে দেওয়ার জন্য। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে মনমোহনের বিদেশি সম্পত্তির মূল্য যে পরিমাণ বেড়েছিল, সেটাই ত্রাণ তহবিলে জমা করে দিয়েছিলেন তিনি।

বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত পশ্চিম পঞ্জাবের গাহ্ নামের অনগ্রসর গ্রাম থেকে জীবনযাত্রা শুরু করেছিলেন মনমোহন সিংহ। যে গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। বাবা গুরমুখ সিংহ ছিলেন বাদাম, কিসমিসের কমিশন এজেন্টের কেরানি। মায়ের মৃত্যু হয় খুব অল্প বয়সে। মনমোহনের যখন মাত্র ১১ বছর বয়স, সে সময় তাঁর বাবা পেশওয়ারে চলে যান। দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। দেশ ভাগের পরে পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়। বাবা বেশ কয়েক মাস নিখোঁজ ছিলেন। সৎ মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। মনমোহন সিংহের একমাত্র পুঁজি ছিল তাঁর মেধা ও পড়াশোনা। সেই পুঁজি নিয়েই প্রথমে ডাক্তারিতে ভর্তি হন। কয়েক মাসের মধ্যে ছেড়ে দেন। পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজে পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে পুরো খরচা উঠত না। তাই অনেক দিন শুধু চকলেট খেয়েই কাটিয়ে দিতেন। বন্ধুদের কাছেও হাত পাততে হয়েছিল।

শুক্রবার দিল্লিতে দিনভর বৃষ্টির মধ্যে মনমোহনের বাসভবনে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা কংগ্রেস নেতারা বলেছেন, বেশি কথা না বললেও তাঁর রসবোধ ছিল। সমালোচনা খোলা মনে নিতে পারতেন। তাই তাঁর বাড়ির দেওয়ালে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন ব্যাঙ্গচিত্র বা কার্টুন বাঁধিয়ে রেখেছিলেন মনমোহন সিংহ। আর তাঁর পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, শুধু বাইরে নয়, বাড়িতেও চুপচাপই থাকতেন মনমোহন। তবে অর্থনীতিবিদ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় তাঁর মুখে হাসি দেখা যেত। মজা করে পরিবারের অনেককে তাঁদের অজ্ঞাতে নিজের মতো ডাকনাম দিতেন। নিজের স্ত্রী গুরশরণ কউরকে মজা করে একটি ডাকনামও দিয়েছিলেন।

কী সেই নাম?

‘গুরুদেব’!

অন্য বিষয়গুলি:

manmohan singh dr. manmohan singh Politician Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy