মহাকুম্ভে পদপিষ্টের ঘটনার দৃশ্য। —ফাইল চিত্র।
সঙ্গমে শাহি স্নান সেরে যখন পারে উঠলাম, মঙ্গলবার রাত তখন ১টা। কাতারে কাতারে লোক সঙ্গমের দিকে আসছেন। যে দিকে তাকাচ্ছি, শুধু মানুষের মাথা। জানতাম, মৌনী অমাবস্যার জন্য ভিড় হবে। অসংখ্য মানুষের মাথার মধ্যেই নিজেকে কোনও রকমে গুঁজে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। ভিড় ঠেলে সঙ্গম থেকে প্রায় এক ঘণ্টায় আমার সেক্টর ৬-এর তাঁবুর এগিয়ে গিয়েছি। যে দিক দিয়ে ফিরছি, সে দিক দিয়েই লোক সঙ্গমের দিকে যাচ্ছে। তখনই লক্ষ করলাম, সে ভাবে পুলিশের দেখা নেই। এখানে এসে ইস্তক এমনই পরিস্থিতি দেখছি। কী ভাবে যাব, কোথায় যাব, নির্দেশ সব জায়গায় চোখে পড়ে না। এখানে মানুষই মানুষকে ঠেলে সঙ্গমের দিকে নিয়ে চলে যায়।
ফেরার সময় বুঝতে পারছিলাম, ভিড় বাড়ছে। রাতে মৌনী অমাবস্যার মধ্যেই সবাই শাহি স্নান সেরে ফেলতে চান। যত ফিরছেন, তার থেকে অনেক বেশি মানুষ সঙ্গমের দিকে চলেছেন। এত ভিড়ের মধ্যে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। দেখি, আমার সামনে এক বৃদ্ধা কোনও রকমে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছেন। সঙ্গে কেউ নেই। ভিড়ের ঠেলায় পড়েই যাচ্ছিলেন, তখন ওঁকে ধরে ফেললাম। বললাম, ‘‘মাইজি, আপ তো গির জায়েঙ্গে। সমালকে চালিয়ে।’’ তাঁকে ভিড় ঠেলে পাশে নিয়ে যেতে গিয়েই বাঁধল বিপত্তি। কয়েক জন পা মাড়িয়ে দিলেন। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ ঘাড়ের উপরে এসে পড়লেন পিছনের মানুষজন।
শুনতে পেলাম, কারা জানি চিৎকার করছে, ‘গির গয়া, গির গয়া। উন লোগোকো বচাও!’ কিন্তু কে কাকে বাঁচাবে? সবার তখন একটাই লক্ষ্য, যত দ্রুত সঙ্গমে পৌঁছানো যায়। যারা পড়ে যাচ্ছে, তার ওপর দিয়েই মানুষ চলে যাচ্ছে। আমিও চিৎকার করছি, কিন্তু সেই শব্দ কারও কানে ঢুকছে কি না, সন্দেহ। কত জন পড়েছিলেন আমার উপরে? ১০-১২ জন হতে পারে। বা তার থেকে বেশি। মনে হচ্ছিল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল, পাথর চাপা পড়েছি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি, বালির উপরে বসিয়ে রেখেছে কেউ বা কারা। কেঁদে ফেলেছিলাম। পাশে বসা এক মহিলা, বোধ হয় পুলিশই হবে, বললেন, ‘‘রো রহ হ্যাঁয় কিউ? আপতো বচ গ্যায়ে। সঙ্গমমে বহুত সারা আদমি কা মত হো গিয়া।’’ বলেন, ‘‘আপনার কপাল ভাল, বেঁচে গিয়েছেন!’’
কোনও কথা কানে ঢুকছিল না। মাথায়-পিঠে-বুকে যন্ত্রণা। পায়ে জুতো নেই। জামাকাপড় কিছুটা ছিড়ে গিয়েছে। শরীরের কয়েক জায়গা কেটে রক্ত পড়ছে। ডাক্তার দরকার। কিন্তু পাই কোথায়? কোথায় হাসপাতাল? কার কাছে সাহায্য চাইব? কী ভাবে তাঁবুতে ফিরব? তখন কেউ কারও কথা শোনার অবস্থায় নেই। সবাই সঙ্গমে যেতে চায়। আমার বাড়ি আলিপুরদুয়ারের হাসিমারায়। তখন মনে হচ্ছিল, ফিরতে পারব তো!
এত কিছু সত্ত্বেও কিন্তু দেখি, আমার ব্যাগ, মোবাইল, টাকাপয়সা— সব অক্ষত। যিনি সব সমেত আমাকে উদ্ধার করেছেন, তাঁকে ঈশ্বরের দূত মনে হচ্ছিল।
তখনও চোখের সামনে দিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ সঙ্গমের দিকে যাচ্ছেন। তখনও জানি না, দুর্ঘটনা কোথায় ঘটেছে, কত জন মারা গিয়েছে। তখন ভিড় ঠেলে প্রয়াগরাজ স্টেশন পর্যন্ত যেতেই আতঙ্ক লাগছে। মনে হচ্ছে, পারব তো? তাও সাহস জুটিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার হাঁটতে শুরু করলাম, মানুষের স্রোতের
উল্টো দিকে।
(অনুলিখন: আর্যভট্ট খান)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy