একশো বছর তপস্যার ফল মেলে সঙ্গমের বালিতে এক মাসের কল্পবাসে। কথিত আছে তেমনই। আজ মহাকুম্ভ মেলায় মাঘী পূর্ণিমার স্নানের শেষে গত এক মাস ধরে কঠোর অনুশাসন পালন করে আসা দশ লক্ষ মানুষের সেই কল্পবাস শেষ হল। কিন্তু সব মিলিয়ে আজ সারা দিনে প্রয়াগরাজে স্নান করলেন কত জন? উত্তরপ্রদেশ সরকারের কর্তাদের আন্দাজ, সংখ্যাটা ১ কোটি ৮০ লক্ষেরও বেশি। বড়সড় কোনও বাধা-বিপর্যয় ছাড়াই এই পর্ব সমাধা হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন।
ডুব দিতে আজ সকাল থেকেই গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমের দিকে পাড়ি দিয়েছিল পুণ্যার্থীর স্রোত। হেলিকপ্টার থেকে ছড়ানো ফুলের পাপড়ি নেমে আসছিল সেই জনস্রোতের মাথায়। গত ২৯ জানুয়ারি অমৃত স্নানের দিনে পদপিষ্ট হয়ে ৩০ জনের মৃত্যুর পরে ভিআইপি প্রোটোকল তুলে দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ পুণ্যার্থীর ভিড়েই হঠাৎ নজরে পড়লেন বাইশ গজের এক ‘ভিআইপি’। স্ত্রী চৈতনাকে নিয়ে অনেকটা হেঁটে, তার পরে নৌকা করে সঙ্গমে পৌঁছে ডুব দিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন কোচ ও অধিনায়ক অনিল কুম্বলে। বেলা ১২টা বাজতে না বাজতেই প্রশাসনিক কর্তারা জানালেন, বিভিন্ন ঘাটে ১ কোটি ৬০ লক্ষের বেশি পুণ্যার্থী স্নান সেরে ফেলেছেন। ভিড়ে দেখা গেল এক শ্বেতাঙ্গিনীকে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। সাংবাদিককে বললেন, ‘‘ভাষায় বর্ণনা করতে পারছি না... এমন অভিজ্ঞতা জীবনে এক বারই হয়।’’
বিপত্তি যেন এ বারের কুম্ভমেলার নিত্যসঙ্গী। থেকে থেকেই আগুন লেগেছে। তার উপরে পদপিষ্ট হয়ে ৩০ জনের মৃত্যুর ঘটনা বিধানসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়ানো ‘হিন্দু্ত্বের মুখ’ যোগীকে ফেলে দিয়েছে চরম অস্বস্তিতে। আজ ভোর ৪টে থেকেই মেলার উপরে নজরদারি শুরু করে দিয়েছিলেন যোগী। লখনউয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের ‘ওয়ার রুম’-এ বসে তিনি ক্রমাগত মহাকুম্ভের খবরাখবর নিয়ে গিয়েছেন। সেই ওয়ার রুমে হাজির ছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি প্রশান্ত কুমার, প্রিন্সিপাল সচিব (স্বরাষ্ট্র) সঞ্জয় প্রসাদ এবং মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্মীরা।
কুম্ভের এসএসপি রাজেশ দ্বিবেদী জানালেন, এর আগে বসন্ত পঞ্চমীর স্নান উপলক্ষে তাঁরা সুরক্ষার যে বন্দোবস্ত করেছিলেন, এ যাত্রায় তাকেই আরও উন্নত করা হয়েছে। ভিড়ের চাপ যে সব জায়গায় হঠাৎ করে বেড়ে যায়, সেই সমস্ত ‘প্রেশার পয়েন্ট’ সামলাতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুণ্যার্থীদের সুরক্ষায় চালু হয়েছে ‘অপারেশন চতুর্ভুজ’। ২৭৫০টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা আর ড্রোনের মাধ্যমে ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে নজরে রাখা হয়েছে প্রতিটি সেকেন্ড। আবার আচমকা উড়ে আসা অবাঞ্ছিত ড্রোন আটকানোর পরিকাঠামোও প্রস্তুত ছিল। পুণ্যার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ১২০০টি অতিরিক্ত শাটল বাসের ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য প্রশাসন। তবে যানজট এড়াতে গত কাল ভোর ৪টে থেকেই গোটা মেলা এলাকাকে ‘নো ভেহিকল জ়োন’ ঘোষণা করা হয়। বিকেল থেকে আপৎকালীন পরিষেবা ছাড়া যাবতীয় যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয় গোটা প্রয়াগরাজ শহরে। এর মধ্যেই বিপর্যয়ের খবর এসেছে ফতেপুর থেকে। মহাকুম্ভগামী একটি মিনিবাস একটি ট্রেলার-ট্রাক্টরে ধাক্কা মারলে বাসযাত্রী চার জন পুণ্যার্থী মারা গিয়েছেন। আহত ১০ জন। মেলা ছেড়ে যাওয়া কল্পবাসীদের উদ্দেশে প্রশাসন আবেদন রেখেছে, তাঁরা যেন ট্রাফিক আইন মানেন এবং সরকারি ও ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া জায়গাতেই গাড়ি রাখেন।
এ বারের মেলায় এখনও পর্যন্ত সমাগম হয়েছে ৪৬ কোটি মানুষের। শেষ স্নান ২৬ ফেব্রুয়ারি, মহাশিবরাত্রিতে। যোগীর দল এখন কুম্ভের সেই শেষ ধাপটুকুই নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার মন্ত্রের সন্ধানে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)