স্বজনহারা: কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নিহতের পরিজন। মঙ্গলবার মুর্শিদাবাদের গ্রামে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বাছাই করা সদস্যদের কাশ্মীর সফরের দিনেই পাঁচ বাঙালি শ্রমিককে খুন করল জঙ্গিরা। গুরুতর আহত আর এক বাঙালি শ্রমিককে আনা হয়েছে শ্রীনগরের হাসপাতালে। কাশ্মীরের ‘শান্তিপূর্ণ’ ছবি তুলে ধরতে উদ্যোগী নরেন্দ্র মোদী সরকার এই ঘটনায় জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্তরে বড় ধাক্কা খেল বলেই মনে করা হচ্ছে। কাশ্মীরে সন্ত্রাসের দীর্ঘ ইতিহাসে ভিন্ রাজ্যের মানুষের উপরে হামলার নজির কম। এ দিনের হত্যাকাণ্ড ২০০৬ সালে বাঙালি পর্যটকদের বাসে গ্রেনেড হামলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহালনগর গ্রাম থেকে যাওয়া জনা পনেরো শ্রমিকের একটি দল কুলগামের কটরাসু গ্রামে একটি কাঠের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। আপেল বাগিচায় কাজ করতে প্রতি বছরই কাশ্মীরে যেতেন ওঁরা। আজ সন্ধেয় তাঁদের কয়েক জনকে ঘর থেকে বার করে এনে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় জঙ্গিরা। নিহত হন পাঁচ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রফিক শেখ (২৮), কামরুদ্দিন শেখ (৩০), মুরসালিম শেখ (৩০), নইমুদ্দিন শেখ (২৮), রফিকুল শেখ (৩০)। আহত হয়ে অনন্তনাগের হাসপাতালে ভর্তি জ়হিরুদ্দিন। সেনার ১৮ নম্বর ব্যাটেলিয়ন ও জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ এলাকায় তল্লাশি শুরু করেছে।
গত ক’দিন ধরেই ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দাদের নিশানা করছে জঙ্গিরা। সব ঘটনাই ঘটেছে দক্ষিণ কাশ্মীরে। ২৪ অক্টোবর শোপিয়ানে আপেল আনতে যাওয়া তিন রাজ্যের ট্রাকচালক খুন হন। এক আপেল বাগানের মালিককে মারধর করা হয়। দু’দিন পরে খুন হন পঞ্জাবের আপেল ব্যবসায়ী চরণজিৎ সিংহ। আহত হন সঞ্জীব নামে আর এক ব্যক্তি। সে দিনই ছত্তীসগঢ় থেকে যাওয়া এক ইটভাটা শ্রমিক খুন হন পুলওয়ামায়। কাল খুন হন জম্মুর ট্রাক চালক নারায়ণ দত্ত। তা ছাড়াও গত কাল শ্রীনগরে লাল চকের কাছে হরি সিংহ বাজার এবং আজ সোপোর টাউন বাসস্ট্যান্ডে গ্রেনেড ছুড়েছে জঙ্গিরা।
কাশ্মীরে নিহত এক শ্রমিকের বাড়িতে সাগরদিঘি থানার ওসি। (নীচে) বাঁ দিক থেকে পাঁচ নিহত শ্রমিক নইমুদ্দিন, কামরুদ্দিন, মুরসালিম, রফিক ও রফিকুল। ডান দিকে আহত জহিরুদ্দিন। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মতে, কড়া পাহারা সত্ত্বেও পাক জঙ্গিরা যে ভারতে ঢুকছে, তা গত কয়েক দিনের হামলা থেকেই স্পষ্ট। তাঁদের মতে, উপত্যকার জঙ্গিরা এখন অস্তিত্ব প্রমাণে মরিয়া। তাই সাধারণ মানুষকেও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। কাশ্মীরে বাঙালি পর্যটক-শ্রমিকদের আনাগোনা দীর্ঘদিনের। ২০০৬ সালে বাঙালি পর্যটকদের বাসে দু’বার গ্রেনেড হামলা হয়। তাতে মোট সাত জন বাঙালি নিহত হন। অন্য দিকে ভিন্ রাজ্যের শ্রমিক বা তীর্থযাত্রীদের নিশানা করার কৌশলও নতুন কিছু নয়। অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানায় হিজবুলের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি ভাঙার আগে বিলাসপুর থেকে যাওয়া শ্রমিকদের খুন করেছিল জঙ্গিরা। ২০০০ এবং ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন অমরনাথ তীর্থযাত্রীরা।
সেনা কর্তারা জানাচ্ছেন, গত এক বছরে কাশ্মীরে সেনা ঘাঁটির নিরাপত্তা কয়েক গুণ বেড়েছে। ফলে সেখানে হামলা চালানোর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত সহজ লক্ষ্যবস্তু বেছে নিচ্ছে জঙ্গিরা। উপত্যকার অর্থনীতিকেও নিশানা করছে তারা। কারণ, ফল সংগ্রহ করতে ভিন্ রাজ্যের ট্রাক চালক-ব্যবসায়ীরা কাশ্মীরে না গেলে উপত্যকায় অস্থিরতা বাড়বে। ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকেরা সেখানে কাজ করতে না পারলে গোটা দেশকে বার্তা দেওয়া যাবে। ফলে আপাতত এই পথেই হাঁটছে জঙ্গিরা। একাধিক সেনা কর্তা ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, এই ধরনের বিচ্ছিন্ন হামলা ঠেকানোর পথ এখনও স্পষ্ট নয়।
এ দিনের ঘটনা কোন জঙ্গি গোষ্ঠী ঘটিয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বাজপেয়ী আমলে সংঘর্ষবিরতি ভাঙতে লস্কর-ই-তইবা হামলা চালিয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। প্রাক্তন সেনাপ্রধান শঙ্কর রায়চৌধুরী এবিপি আনন্দ নিউজ চ্যানেলকে বলেন, ‘‘বাহিনীর উপরে হামলা করে জঙ্গিরা ধাক্কা খাচ্ছে। তাই এখন অর্থনীতির উপরে হামলার চেষ্টা হচ্ছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের জোর করে ডেকে আনাটা ভুল হল মনে হচ্ছে। এঁরা কিন্তু ভারতবন্ধু নন। পরে কী রিপোর্ট দেবেন আমরা জানি না।’’ এই ঘটনায় শোকপ্রকাশ করে নিহতদের পরিবারকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা, বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘ভারত সরকারের দেওয়া ভরসায় ভরসা করে রুটিরুজির জন্য কাশ্মীরে গিয়ে বাংলার শ্রমিকরা আজ প্রাণ দিলেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy