Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

হাসপাতালেই দিন কাটছে মুক্ত লৌহমানবীর

ভেঙেছেন অনশন, জামিনের বিনিময়ে মিলেছে মুক্তিও। তবু নিজভূমে পরবাসীর দশা হয়েছে মণিপুরের ‘লৌহমানবী’র। ‘মণিপুরের মুখ’কেই ত্যাগ করেছে পরিবার ও ইমারা (মায়েরা)। ‘শর্মিলা কানবা লুপ’ সংগঠনের নাম থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে শর্মিলার নাম।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
ইম্ফল শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৬ ০৪:৩১
Share: Save:

ভেঙেছেন অনশন, জামিনের বিনিময়ে মিলেছে মুক্তিও। তবু নিজভূমে পরবাসীর দশা হয়েছে মণিপুরের ‘লৌহমানবী’র। ‘মণিপুরের মুখ’কেই ত্যাগ করেছে পরিবার ও ইমারা (মায়েরা)। ‘শর্মিলা কানবা লুপ’ সংগঠনের নাম থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে শর্মিলার নাম।

তবু ভাঙছেন না ইরম শর্মিলা চানু। উল্টে দৃঢ় গলায় জানাচ্ছেন, প্রেমিকের হেনস্থাই তাঁকে সিদ্ধান্ত বদলের কথা ভাবিয়েছে। প্রশ্ন ছুড়ছেন, নাগরিক সমাজ কি তবে তাঁর মৃত্যুতেই শান্তি পেত? দিন শেষে, তাঁর জেদের সামনে ধীরে ধীরে নরম হচ্ছে শর্মিলা বিরোধী প্রতিবাদের ভাষা।

আফস্পা নয়, আপাতত শর্মিলার প্রথম লড়াই মাতৃভূমির সঙ্গেই। ১৬ বছর পরের মুক্তির পরেও ঠিকানা বদল হয়নি। কাল রাতে শরীর খারাপ হওয়ার পরে হাসপাতালে ফিরে এসেছেন শর্মিলা। ফের ঠিকানা জওহরলাল নেহরু হাসপাতালের সেই পুরনো ঘর। কিন্তু অনশন ভাঙার ২৪ ঘণ্টা পরে সিদ্ধান্তে অনড় শর্মিলার পাশে ফিরে এসেছেন তাঁর এত দিনের সহযোদ্ধা বাবলু লৌইতংবাম। সঙ্গে আছেন শুভানুধ্যায়ী, প্রাক্তন রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা টি রমেশ।

কিন্তু সঙ্গীর তুলনায় প্রতিবাদীর সংখ্যা অনেক বেশি। কাল নগর দায়রা আদালতে শর্মিলার সিদ্ধান্তে কান্নায় ভেঙে পড়া ইমাদের আবেগ আজও সমান তীব্র। কেইসামপাতের দফতরে বসে ‘আপুন বা মণিপুর কানবা ইমা লুপ’-এর সহ সভাপতি ইমা নাংবি কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, “আমরা ওঁর মায়ের মতো ছিলাম। অনশন ভাঙার সিদ্ধান্ত হোক বা বিয়ের সিদ্ধান্ত— মাকে জিজ্ঞাসা না করেই কী ভাবে নিতে পারে সে? ও আমাদের আবেগকে শেষ করে দিল। আমরাও শর্মিলা কানবা লুপের নাম থেকে শর্মিলা ছেঁটে ফেলে আফস্পা বিরোধী কানবা লুপ রাখব।” কিন্তু শর্মিলা যদি আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান? নতুন লড়াইয়ে আপনাদের পাশে পেতে চান? খানিক থমকে ইমা নাংবি বলেন, “তা নিয়ে আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু আমরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকছি, থাকব। ভুয়ো সংঘর্ষের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন ৩৬ বছর ধরে চলছে। শর্মিলাকে ছাড়াও তা চলবে।”

বাবলু অবশ্য এ দিন বলেন, “শর্মিলা আবেগতাড়িত হয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করে, ঝোঁকের মাথায় কথা বলে ফেলছেন। মুখ্যমন্ত্রী হতে চাই কথাটা না বললেই পারতেন তিনি। এতে মানুষের মনে ভুল ধারণা জন্মাচ্ছে। অনশন ভেঙে মানুষের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের মন বুঝে, ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ করা উচিত ছিল।” পরিবারের সঙ্গে শর্মিলার যোগাযোগ বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে বাবলু বলেন, “সময় দিন। ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। অভিমান রয়েছে দু’পক্ষেই।” কিন্তু শর্মিলা রাজনীতিতে নামলে আপনারা কী সঙ্গ দেবেন? বাবলু বলেন, “আমরা সব দিক খোলা রাখছি।”

শর্মিলা আগেই জানিয়েছেন, অনশন ছাড়লেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই বাড়ি যাবেন না বা মায়ের সঙ্গেও দেখা করবেন না। কাল অনশন ভাঙার সময় হাসপাতালে না এলেও এ দিন সকালে তাঁর দাদা সিংহজিৎ একাই বোনের সঙ্গে দেখা করে যান। তাঁর মতে, হাসপাতালে একা বসে জনবিচ্ছিন্ন এক কল্পনার জগতে বাস করছিলেন শর্মিলা। সেখান থেকেই মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আইন প্রত্যাহারের কথা মাথায় ঢোকে।

তাৎক্ষণিক আবেগের বশেই কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৪৪ বছরের শর্মিলা?

সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যে ব্যক্তির সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসেছিলেন চানু, সেই সুরেশ জানালেন, প্রেমিক ডেসমন্ডকে যে ভাবে চানুর সমর্থকরা মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়, তা মেনে নিতে পারেননি শর্মিলা। তখনই অনশন ভেঙে স্বাভাবিক জীবনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুরেশ বুঝিয়ে তাঁকে আটকান। কিন্তু চলতি বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপ বাড়তে থাকে। সুরেশ বলেন, “তার মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে চানুকে প্রায় টেনেই ফেলেছিল। সে বারও কোনও মতে চানুকে আটকাই। কিন্তু প্রেমিকের অপমান, শর্মিলার নামে আসা টাকা নয়ছয় হওয়া, শর্মিলার নাম ব্যবহার করে অনেকের ওঠার চেষ্টা— এ সবই ভিতরে ভিতরে শান্ত মেয়েটাকে অশান্ত করে তুলেছিল।” সুরেশ জানান, সুপ্রিম কোর্ট আফস্পার অপব্যবহার রুখতে ইতিবাচক রায় দেওয়ার পরেই তিনি চানুকে বলেছিলেন, আন্দোলনের দিক বদলের এটাই সঠিক সময়। কিন্তু শেষ দিকে তিনি কোনও পরামর্শই নিচ্ছিলেন না। নিজের মত মতোই চলছিলেন।

আপাতত হাসপাতালে থাকলেও, চানুর জন্য আশ্রয়ের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে রেড ক্রস সোসাইটি। রাজ্য রেড ক্রসের সাম্মানিক সচিব ওয়াই মোহেন সিংহ জানান, দু’বছর আগে শর্মিলা তাঁকে ডেকে রেড ক্রসের জন্য তিন লক্ষ টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে নাশকতায় নিহতদের বিধবাদের হাতে ৫০ হাজার টাকার সাহায্য তুলে দেওয়ার প্রকল্প শুরু হয়েছে। রেড ক্রস শর্মিলার কাছে ঋণী। তাই শর্মিলাকে তাঁরা রেড ক্রস ভবনেই রাখতে চান। মোহেন বলেন, “এখন অনশন ভেঙেছেন বলে রাজ্যবাসীর জন্য
তাঁর করা ১৬ বছরের অনশন তো মিথ্যে হয়ে যায় না। অন্য কেউ তো তাঁর স্থানে একইভাবে অনশনে বসে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন না।”

অবশ্য ১৬ বছর না খেয়ে থাকার ফলে শর্মিলার দেহ চট করে বাইরের খাবার নেবে না। সেই সঙ্গে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শর্মিলার নিরাপত্তার প্রশ্নও রয়েছে। তাই, আপাতত কয়েক দিন হাসপাতালেই রেখে শর্মিলাকে সুস্থ-সবল করে তুলে তারপর তাঁকে নতুন ঠিকানায় পাঠানো হতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

Chanu Sharmila fasting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy