পড়ে রয়েছে সন্দেহভাজন মাওবাদীদের দেহ। ছবি: পার্থ চক্রবর্তী।
গোয়েন্দা রিপোর্টেই নাকি এসেছিল আগাম সতর্কতা। পুলিশের দাবি, সেই সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা পলামুর সতবেরিয়া ব্লকের বকোরিয়া গ্রামের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে মাওবাদীদের একটি দল। তার পরেই এলাকায় টানা তল্লাশি অভিযান শুরু করেছিল সিআরপি-র কোবরা বাহিনী ও ঝাড়খণ্ড পুলিশ যৌথ দল। নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি, সোমবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ তাদের টহলদারি দলের গাড়ির সামনে হঠাৎই এসে পড়ে একটা স্করপিও গাড়ি। আর সঙ্গে সঙ্গে নাকি সেই গাড়ির ভিতর থেকে পুলিশকে লক্ষ করে শুরু হয়ে যায় গুলিবৃষ্টি।
নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি, এর পর প্রায় তিন ঘণ্টা গুলির লড়াই চলে। নিহত হয় ১২ মাওবাদী। এদের মধ্যে তিন জনের বয়স ১১ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। পুলিশ জানিয়েছে, এই তিন কিশোর কী ভাবে মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত হল, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যদিও সংঘর্ষের ধরন ও তিন নাবালকের মৃত্যু নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। তাঁদের বক্তব্য, নিহতদের প্রত্যেকের দেহেই গুলির মারাত্মক ক্ষত রয়েছে। কিন্তু পুলিশ ও কোবরার গোটা বাহিনীই অক্ষত। অথচ পুলিশই নাকি অতর্কিত হামলার মুখে পড়েছিল। স্করপিও থেকেই প্রথম গুলি চলেছিল বলে তারা দাবি করছে। সে ক্ষেত্রে অন্ধকারে ঘন জঙ্গলে তিন ঘণ্টা সংঘর্ষের পরেও পুলিশের গায়ে কেন আঁচড়টুকুও লাগল না— সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। স্বাভাবিক ভাবেই ইঙ্গিতটা ভুয়ো সংঘর্ষের দিকে। যে দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন পুলিশকর্তারা। বরং ঘটনাস্থল ঘুরে সিআরপি-র ডিজি প্রকাশ মিশ্র জানান, গত রাতে ওই স্করপিও গাড়িটির সঙ্গে মাওবাদীদের আরও একটি গাড়ি ছিল। বেগতিক দেখে সেটি পালিয়ে যায়।
সন্দেহভাজন মাওবাদীদের থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র। ছবি: সৈকত চট্টোপাধ্যায়।
আজ বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঝাড়খণ্ড পুলিশের ডিজি ডি কে পাণ্ডে। এডিজি (অপারেশন্স) এস এন প্রধান বলেন, ‘‘সার্চ অপারেশন দিন কয়েক ধরেই চলছিল। নিহত জঙ্গিদের কাছ থেকে সাতটি সেল্ফ লোডিং রাইফেল (এসএলআর), একটি ইনসাস রাইফেল ও ২৫০ থেকে ৩০০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়েছে।’’ গত কালের ঘটনাকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরাট সাফল্য হিসেবেই দেখছেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে পুলিশ কর্তা— সকলেই। মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস পুলিশকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পলামুর আইজি নটরাজনের কথায়, ‘‘এই ঘটনা নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে খুব বড় সাফল্য। এর ফলে মাওবাদীদের মনোবল অনেকটাই ভেঙে যাবে। আমাদের ছেলেরা চাঙ্গা হবে।’’
সাম্প্রতিক কালে বারবারই মাওবাদীদের অতর্কিত হানার মুখে পড়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। প্রাণ গিয়েছে বহু জওয়ানের। পুলিশ সূত্রের দাবি, গত কালের সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে রয়েছে ওই এলাকার মাওবাদী সংগঠনের জোনাল কম্যান্ডার আর কে প্রসাদ ওরফে ‘আরকেজি’। ২০১৩ সালে লাতেহারে মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ৯ জন সিআরপি জওয়ান মারা যান। তার পর নিহত এক জওয়ানের পেটে তাজা বোমা রেখে পেট সেলাই করে দিয়েছিল মাওবাদীরা। অভিযোগ, সেই পরিকল্পনা ছিল এই আরকেজি-র। সে ছিল পাশ করা ডাক্তার। মাওবাদী সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ নেতা অরবিন্দজির খুব ঘনিষ্ঠ ছিল আরকেজি। তার মাথার দাম ছিল পাঁচ লাখ টাকা। আরকেজি ছাড়া নিহতদের মধ্যে আরও এক জনের পরিচয় জানা গিয়েছে। তার নাম উদয় যাদব। সে লাতেহার জেলার মণিকা গ্রামে প্যারা-টিচারের কাজ করত।
স্থানীয় গ্রামবাসীদের বক্তব্য, গত রাতটা তাঁরা জেগেই কাটিয়েছেন। রাত সাড়ে এগারোটা থেকেই জঙ্গল থেকে সমানে ভেসে আসতে থাকে গুলির আওয়াজ। যদিও পুলিশ জানিয়েছে, এই সংঘর্ষের জেরে পাল্টা-হামলারও আশঙ্কা করছে তারা। পলামু জেলার সব থানাকেই সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। রাজ্যের সীমানাবর্তী মাওবাদী-প্রভাবিত জেলাগুলিতেও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন হয়েছে। বাড়তি সর্তকতা জারি হয়েছে ছত্তীসগঢ় সীমানায়।
সন্দেহভাজন মাওবাদীরা যে গাড়িটিতে ছিল, সেই ডব্লিউবি-৬০-ই২০১১ নম্বরের স্করপিওটি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। নম্বর প্লেট দেখে জানা যায়, গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল উত্তর দিনাজপুরে। ওই জেলার আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক পালদেন ভুটিয়ার দাবি, ২০১২ সালের ১১ মে ওই স্করপিও-টির মালিকানা বদল হয়েছিল। তাঁর দফতর থেকে নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়ে গাড়িটি শিলিগুড়ি আঞ্চলিক পরিবহণ দফতরে নথিভুক্ত হয়। তবে গাড়িটির আগের ও বর্তমান মালিক কারা, তা তিনি জানেন না।
যদিও পুলিশ সূত্রের খবর, ওই গাড়িটি ধানবাদ এলাকার বাসিন্দা জনৈক রবিকুমার সিংহের নামে নথিভুক্ত রয়েছে। তবে ওই ব্যক্তি ধানবাদের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে গাড়িটি উত্তরবঙ্গে নথিভুক্ত হল, সেই প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের সন্দেহ, হয়তো ধানবাদের পরিবহণ দফতরে গাড়িটি এখনও নথিভুক্ত না হওয়ায় সাময়িক অনুমতি সাপেক্ষে পুরনো নম্বর ব্যবহার করা হচ্ছিল। তবে গাড়িটি চুরি করে ভুয়ো নম্বর প্লেট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল কি না, সেই সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy